আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বহুবার আমাদেরকে নামায আদায় করার নির্দেশ দিতে গিয়ে বলেন: أَقِيمُوا الصَّلَاةَ। আমি অনুবাদ করি “তোমরা নামায আদায় কর বা নামায পড়।”
অনেকে “নামায আদায় কর বা পড়” এই অনুবাদের সাথে দ্বিমত করেন। তাদের বলতে চান আল্লাহ্ বলেননি: صلوا (তোমরা নামায পড়)। তিঁনি বলেছেন: أقيموا الصلاة (তোমরা নামায কায়েম কর বা প্রতিষ্ঠা কর)। শাব্দিক দ্বিমতে আমার দ্বিমত নেই। কেননা নিজে নামায পড়, নিজের উপর নামায কায়েম কর বা প্রতিষ্ঠা কর— একই অর্থবোধক।
কিন্তু ‘কায়েম বা প্রতিষ্ঠা’ দ্বারা অনেকে বোঝাতে চান: “নিজে নামায পড়, অন্যকে নামায পড়াও, সমাজ ও রাষ্ট্রে নামায প্রতিষ্ঠা কর।”
ইসলাম আমাদেরকে অধীনস্তদের নামায পড়ার নির্দেশ দিতে আদেশ করে এবং সাধ্যানুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রে নামায চালু করার নির্দেশ করে; যা অন্য আয়াত ও হাদিসে এসেছে। এটি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। এতে কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হলো: أقيموا الصلاة এই নির্দেশের মধ্যে ‘নামায কায়েম’ দ্বারা কি উদ্দেশ্য অন্যকে নামায পড়ানো, সমাজে বা রাষ্ট্রে নামায প্রতিষ্ঠা করা; নাকি নিজে নামায পড়া?
আরবী قام শব্দটির অর্থ দাঁড়ানো; এটি অকর্মক ক্রিয়া। আর এই ক্রিয়ার সকর্মক রূপ হচ্ছে: إقامة অর্থাৎ অন্যকে বা অন্য কিছুকে দাঁড় করানো, প্রতিষ্ঠা করা, কায়েম করা। আল্লাহ্ তাআলা যখন নির্দেশসূচক ক্রিয়া ব্যবহার করে আমাদেরকে الصلاة (নামায) إقامة (ইক্বামত) করার নির্দেশ দেন তখন ‘নামায কায়েম’ একটি ফরয ইবাদত। যেহেতু নির্দেশসূচক ক্রিয়া আবশ্যক হওয়াকে অনিবার্য করে। বরং ঈমানের পর ইসলামে সর্বাধিক তাগিদপূর্ণ আবশ্যকীয় ইবাদত হচ্ছে ‘নামায কায়েম’ এবং ‘নামায কায়েম’ বর্জন করা হচ্ছে কবিরা গুনাহ।
যদি ‘নামাযকে কায়েম’ করার অর্থ হয় নামায নিজে আদায় করা; তাহলে একজন নামাযী নিজে নামাযের রুকুন, হুকুম ও ওয়াজিবগুলো সঠিকভাবে পালন করে নামায আদায় করলে তিনি أقيموا الصلاة (নামায কায়েম কর) নির্দেশের মাধ্যমে আরোপিত ফরয দায়িত্ব থেকে দায়মুক্ত হয়ে গেলেন এবং কবিরা গুনাহ থেকে রক্ষা পেলেন।
অন্যদিকে, যদি নামায কায়েম করার অর্থ হয় অন্যকে নামায পড়ানো, সমাজ ও রাষ্ট্রে নামায প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে তিনি যথাযথ নিয়মে নামায পড়া সত্ত্বেও এই নির্দেশের দায় থেকে মুক্ত হবেন না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি পরিবারের সকল সদস্যকে নামায পড়াতে সক্ষম হন; সমাজে ও রাষ্ট্রে নামায প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। বরং নির্দেশ লঙ্ঘনের কারণে তিনি কবিরা গুনার দায়ে থাকবেন।
আমার জানামতে কোন ফকীহ বা ইসলামী আইনজ্ঞ এ কথা বলেননি যে, আয়াতে إقامة الصلاة (নামায কায়েম)-এর অর্থ অন্যকে নামায পড়ানো। বরং সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য তাফসিরকারক থেকে إقامة الصلاة এর যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তা হলো যথাযথভাবে নিজে নামাযকে আদায় করা, সুচারুভাবে নিজের উপর নামায প্রতিষ্ঠা করা, ওয়াক্তমত নিয়মিত নামায আদায় করা।
যেমন ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন: إقامة الصلاة الصلاة تمامُ الرُّكوع والسُّجود، والتِّلاوةُ والخشوعُ، والإقبالُ عليها فيها (নামায প্রতিষ্ঠা মানে: নামাযের রুকু, সেজদা, তেলাওয়াত, খুশু ও মনোযোগকে পরিপূর্ণ করা)। ইবনে আব্বাসের আরেকটি উক্তি হচ্ছে: ويقيمون الصلاة، قال: الذين يقيمون الصلاةَ بفرُوضها (“তারা নামায কায়েম করে”: তিনি বলেন: যারা ফরজগুলোসহ নামায কায়েম করে।)
ইমাম তাবারী বলেন:
وإقامتها: أداؤها -بحدودها وفروضها والواجب فيها- على ما فُرِضَتْ عليه. كما يقال: أقام القومُ سُوقَهم، إذا لم يُعَطِّلوها من البَيع والشراء فيها،
(নামায কায়েম করা: যেভাবে তার উপর ফরয করা হয়েছে সেইভাবে তথা নামাযের সীমারেখা, ফরয ও ওয়াজিবগুলো রক্ষা করে নামায আদায় করা। যেমন কোন গোত্র যখন বেচাকেনা থেকে বাজার অচল করে দেয় না সেক্ষেত্রে বলা হয়: أقام القوم سوقهم তারা বাজার কায়েম/প্রতিষ্ঠা করেছে।)
ইমাম বাগাভী বলেন:
قَوْلُهُ تَعَالَى: {وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ} أَيْ يُدِيمُونَهَا وَيُحَافِظُونَ عَلَيْهَا فِي مَوَاقِيتِهَا بِحُدُودِهَا، وَأَرْكَانِهَا وَهَيْئَاتِهَا
(“তারা নামায কায়েম করে”: তারা নামাযকে অব্যাহতভাবে নিয়মিত ওয়াক্তমত, সীমারেখাগুলো, আরকানগুলো ও কাঠামোগুলো ঠিক রেখে আদায় করে।)[তাফসিরে বাগাভী (১/৬২)]
ইবনে আশুর বলেন:
فَإِقَامَةُ الصَّلَاةِ اسْتِعَارَةٌ تَبَعِيَّةٌ شَبَّهَتِ الْمُوَاظَبَةَ عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالْعِنَايَةَ بِهَا بِجَعْلِ الشَّيْءِ قَائِمًا،
(নামায প্রতিষ্ঠা করা এটি একটি তাবাঈ উপমা; নিয়মিত নামায আদায় করা ও নামাযের উপর গুরুত্বারোপ দেয়াকে নামায দণ্ডায়মান হওয়ার সাথে সাদৃশ্য দেয়া হয়েছে।) [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর (১/২৩১)]