দ্বীন আল্লাহ তাআ’লার হেদায়েত, যা তিনি সর্বাগ্রে মানুষের সহজাত মানবীয় প্রবৃত্তি তথা ফিতরাতে সঞ্চারিত করেছেন; অতঃপর তিনি এই দ্বীনের যাবতীয় জরুরী বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ তাঁর নবীগণের মাধ্যমে মানবজাতিকে প্রদান করেছেন। নবী প্রেরণের এই ধারাবাহিকতায় মুহাম্মদ [صلی اللہ علیہ وسلم] হলেন সর্বশেষ। এ কারণে জমিনের বুকে দ্বীনের একমাত্র উৎস কেবলই মুহাম্মদ [صلی اللہ علیہ وسلم]-এর ব্যক্তিসত্তা। কেবল তার ব্যক্তিসত্তার মাধ্যমেই কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতি তার প্রতিপালকের হেদায়েত লাভ করতে সক্ষম। কেবল তার ব্যক্তিসত্তারই জন্যই এ অধিকার সংরক্ষিত যে, তিনি যে জিনিসকে তার কথা ও কাজ অথবা মৌনসম্মতি ও অনুমোদনের মাধ্যমে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করেন, সেগুলোই দুনিয়ার শেষ দিন পর্যন্ত সত্য দ্বীন হিসেবে বিবেচ্য:
“তিনিই সে সত্তা, যিনি উম্মী [বা নিরক্ষরদের] মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাঁর আয়াতগুলো তাদের নিকট পাঠ করে ও তাদের পরিশুদ্ধ করে এবং (এ উদ্দেশ্যে) তিনি তাদের শিক্ষা দেন কানুন [বিধি-বিধান] ও হিকমত।” (সূরা জুমুআ’, ৬২:২)
এই কানুন ও হিকমত-কে সত্য দ্বীন “ইসলাম” হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ইসলামের উৎসের বিবরণ সম্পর্কে আমরা বলি: আল্লাহর রাসূল [صلی اللہ علیہ وسلم] থেকে এ দ্বীন তার সাহাবীদের ইজমা [ঐক্যমত] এবং মৌখিক বর্ণনা ও ব্যবহারিক কর্মের নিরবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা তথা তাওয়াতুরের মাধ্যমে আমাদের নিকট স্থানান্তরিত হয়েছে এবং তা আমাদের নিকট দু’ভাবে পৌঁছেছে:
১. কুরআন মাজীদ
২. সুন্নাত
কুরআন মাজীদের ব্যাপারে প্রতিটি মুসলিম এই হাকিকত সম্পর্কে অবগত যে, আল্লাহ তাআ’লা এ গ্রন্থ তাঁর শেষ নবী মুহাম্মদ [صلی اللہ علیہ وسلم]-এর উপর নাযিল করেছেন এবং এর নাযিলের পর আজ পর্যন্ত গোটা মুসলিমদের নিকট সম্মিলিতভাবে কোনোরূপ অস্পষ্টতা ছাড়াই ঠিক সেভাবে মওজুদ রয়েছে, যেভাবে তা মুহাম্মদ [صلی اللہ علیہ وسلم]-এর উপর নাযিল হয়েছে; অতঃপর তিনি তার সাহাবীদের ইজমা এবং মৌখিক বর্ণনার নিরবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা তথা তাওয়াতুরের মাধ্যমে সামান্যতম পরিবর্তন ও পরিমার্জন ছাড়াই দুনিয়াবাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
সুন্নাত দ্বারা আমরা দ্বীনে ইব্রাহীমীর ওইসব আচার-অনুষ্ঠান ও রেওয়াজকে বুঝাচ্ছি, যেগুলো নবায়ন ও সংস্কারের পর কিছু পরিবর্ধনসহ নবী [صلی اللہ علیہ وسلم] তার অনুসারীদের দ্বীন হিসেবে জারি করেছেন। কুরআন নবীকে মিল্লাতে ইব্রাহীম তথা ইব্রাহীমী ধর্ম অনুসরণের আদেশ দিয়েছে। এসব আচার-অনুষ্ঠান ও রেওয়াজ ইব্রাহীমী ধর্মের অংশ। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
“আর (এ কারণে) আমরা আপনার নিকট এ মর্মে ওহী নাযিল করেছি যে, আপনি এই ইব্রাহীমের পথ অনুসরণ করে চলুন, যিনি ছিলেন একেবারে একনিষ্ঠ, আর না ছিলেন তিনি মুশরিকদের কেউ।” (সূরা আন-নাহল, ১৬:১২৩)
এই প্রক্রিয়ায় দ্বীন হিসেবে আমরা যা পেয়েছি, তা নি¤œরূপ:
ইবাদত
১. নামায
২. যাকাত ও সাদাকায়ে ঈদুল ফিতর
৩. রোযা ও ইতিকাফ
৪. হজ্জ ও উমরা
৫. কুরবানী ও আইয়্যামে তাশরীকের তাকবীর
সামাজিক বিধিবিধান
১. বিবাহ ও তালাক এবং এ দুটোর সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াদি
২. মাসিক ও প্রসব পরবর্তী ঋতুকালে দৈহিক মিলন থেকে বিরত থাকা
পানাহার
১. শুকর, রক্ত, মৃত ও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে জবাই করা জন্তুর মাংস খাওয়া বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা
২. আল্লাহর নাম নিয়ে পশু জবাই করা
সামাজিক রীতিনীতি ও শিষ্টাচার
১. আল্লাহর নাম নিয়ে পানাহার শুরু করা এবং তা ডান হাত দিয়ে সম্পন্ন করা
২. সাক্ষাতের সময় السلام علیکم (আস-সালামু আলাইকুম) এবং তার জবাব দেয়া
৩. হাঁচি দেয়ার পর الحمد للّٰہ (আল-হামদু) বলা এবং তার জবাবে یرحمک اللّٰہ (ইয়ারহামু-কাল্লাহু) বলা
৪. গোঁফ বা মোচ ছোট রাখা
৫. নাভীর নিচের পশম কাটা
৬. বগলের পশম পরিষ্কার করা
৭. বড় হওয়া নখ কাটা
৮. পুরুষদের খতনা করা
৯. নাক, মুখ ও দাঁতের পরিচ্ছন্নতা
১০. ইসতিনজা (প্রসাব ও পায়খানার পর পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা)
১১. মাসিক ও প্রসব পরবর্তী ঋতুর পর গোসল করা
১২. জানাবাতের গোসল তথা বীর্যপাত ও যৌন মিলনের পর গোসল করা
১৩. মৃতের গোসল দেয়া
১৪. মৃতের দাফন ও কাফনের ব্যবস্থা করা
১৫. লাশ দাফন করা
১৬. ঈদুল ফিতর
১৭. ঈদুল আযহা
এসবই সুন্নাত এবং এসবের ব্যাপারে নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় যে, প্রামাণিকতার দিক থেকে কুরআন মাজীদ ও সুন্নাতের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। কুরআন মাজীদ আমরা যেভাবে সাহাবীগণের ইজমা ও মৌখিক বর্ণনার তাওয়াতুরের মাধ্যমে পেয়েছি, ঠিক সেভাবে সুন্নাত আমরা ইজমা ও ব্যবহারিক কর্মের তাওয়াতুরের মাধ্যমে পেয়েছি। কুরআন মাজীদের ন্যায় প্রতিটি যুগের মুসলিমগণ সম্মিলিতভাবে এসব রীতিনীতি পালন করে এসেছে, তার প্রামাণিকতা বিদ্যমান। ফলশ্রুতিতে, এসবের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ বা বিতর্কের সামান্যতম অবকাশ বাকি নেই।
কোনো সন্দেহ ছাড়াই দ্বীন এই দুটো উৎসের মাঝেই নিহিত। এর বাহিরে কিছুই দ্বীন নয়, আর না সেগুলোকে দ্বীন বানানো যেতে পারে।
রাসূল [صلی اللہ علیہ وسلم]-এর কথা ও কাজ অথবা মৌনসম্মতি ও অনুমোদনের বিবরণ সম্বলিত একক বর্ণনা বা আখবারে আহাদ, যা সচরাচর “হাদীস” নামে পরিচিত, সে ব্যাপারে এ হাকিকত অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে, [হাদীসের] প্রচার-প্রসার ও সংরক্ষণে নবী নিজ তরফ থেকে কখনো কোনো ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি, বরং তিনি তা শ্রোতা ও প্রত্যক্ষকারীর উপর ছেড়ে দিয়েছেন; যে ইচ্ছা করবে সে তা অপরের কাছে পৌঁছে দিবে, আবার ইচ্ছা করলে তা পৌঁছাবে না। এ কারণে হাদীসের ভিত্তিতে দ্বীনের মাঝে কোনো বিশ্বাস ও কর্মের সংযোজন হয় না। বরং দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত যা কিছুর বিবরণ হাদীসে পেশ করা হয়, তা কুরআন ও সুন্নাতে পরিবেষ্টিত এই দ্বীনের মর্ম উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ; এবং এই দ্বীন মোতাবেক আমল করার ক্ষেত্রে নবী কর্তৃক দেখানো উত্তম আদর্শ বা উসওয়ায়ে হাসানার বিবরণ। হাদীসের গণ্ডি এসব বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। এ কারণে এই গণ্ডি বহিভর্‚ত কোনো জিনিস না হাদীস হতে পারে, আর না কেবল হাদীস হিসেবে বর্ণিত হওয়ার কারণে সেগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে। হ্যাঁ, এই গণ্ডির মাঝে থেকে কেউ যদি কোনো হাদীসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়, তবে নবী [صلی اللہ علیہ وسلم]-এর কথা ও কাজ অথবা মৌনসম্মতি ও অনুমোদন হিসেবে উক্ত হাদীস গ্রহণ করাটা তার উপর আবশ্যক [ঈমানী] দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এর ব্যতিক্রম করাটা ওই ব্যক্তির জন্য বৈধ নয়। বরং উক্ত হাদীসে যদি কোনো নির্দেশনা (হুকুম) বা ফয়সালা বর্ণিত হয়, তবে তার সামনে পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়।