তাফসির কী? কুরআনের ব্যাখ্যা। কুরআনের তর্জমার পরে কুরআন বিশ্লেষণের আলাপনকে তাফসির বলা হয়। তাফসিরে আয়াত সংশ্লিষ্ট হাদিস, আক্বায়েদ, ফিক্বাহ, ইলমুল কালাম ও সামাজিক জ্ঞানসমূহের বর্ণনা সহজাতভাবে আসে।
তাফসির সম্পর্কে উইকিপিডিয়া সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছে।
Tafsir (Arabic: تفسير, translit. Tafsīr, lit. ‘Interpretation’) is the Arabic word for exegesis, usually of the Qur’an. An author of tafsir is a mufassir (Arabic: مُفسّر; plural: Arabic: مفسّرون, translit. mufassirūn). A Qur’anic tafsir attempts at providing elucidation, explanation, interpretation, or commentary for clear understanding and conviction of God’s will.
সহজ তো! কুরআনের ভাববিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যাই তাফসির।
কুরআনের তাফসির ওহির সূচনা থেকে হয়ে আসছে। হাদিসতো কুরআন মজিদের জীবন্ত প্রতিলিপি। মুহাম্মদ (সা) এর বরকতময় জীবন প্রকৃতার্থে কুরআন মজিদের ছায়াচিত্র। কুরআনের বেস্ট তাফসির হল মুহাম্মদ (স) এর জীবনচরিত।
তাফসিরের পৃথিবী, পৃথিবীর আশ্চর্য আরেক পৃথিবী। কুরআন মজিদ তো প্রথাগত কিতাব নয়। আল্লাহ রব্বুল ইজ্জতের কালাম কুরআন মজিদ। কুরআন পড়লে, অনুভব করা যায়, এটা সম্পূর্ণ বিস্ময় জাগানিয়া বই। সব বই থেকে কুরআন সম্পুর্ন আলাদা। কুরআনের গঠন, বক্তব্য, ছাঁচ, আবেদন সবি সম্পূর্ণ অলৌকিক ভিন্নরূপ, ভিন্নরুচিকর ও ভিন্নতর সুষমাময়ী।
কুরআনের মতো কুরআনের তাফসিরও অপূর্ব ও অপরূপা জাহান। কুরআন যাদের তার তাফসিরের শামিয়ানায় জায়গা দিয়েছে, তারা কতো নিয়ামতধন্য ও সৌভাগ্যসম্পন্ন, আমরা কল্পনা করতেও অপারগ। মহান রব, আপনাকে ও আমাকে কুরআন ও তাফসিরের ফল্গুধারায় বিশুদ্ধ নিমিশ্ল হওয়ার নিয়ামত আতা’ করুন। আমিন!
কুরআন মজিদের সুখৈশ্বর্যপূর্ণ সুধা একবার পেয়ে গেলে, মানুষ সোনা ও মণিকাঞ্চন হয়ে যায়। নাহ, মানুষ ওহির সৌদায় মালামাল হয়ে যায়। তখন, মানুষের বুক ও চোখ নুরানিয়্যত ও রূহানিয়্যতে ঝলমল হয়ে যায়। মানুষের চিন্তা, বিচিন্তা ও জীবনপথ কুরআনের বিমলতায় বিমিশ্র হয়ে পথান্তর পাড়ি দেয়।
কুরআন মজিদের তাফসির অশেষ অনন্ত। আর কুরআনের তাফসির আসলেই অনিঃশেষ্য। আল্লাহর কথা তো সমাপ্ত হওয়ার অবকাশ নেই। চিন্তা করাও ভুল।
অজস্র তাফসির লিখিত হয়েছে। এখনো সারা পৃথিবীময় তাফসিরের দরস চলছে। তাফসির গবেষণা চলছে। তাফসির লিপিবদ্ধ হচ্ছে। এবং এ তাফসিরি সফর অব্যাহত থাকবে।
কুরআন মজিদের তাফসির আপনি পড়েছেন। কোথাও না কোথাও। নিদেনপক্ষে তর্জমা পড়ার সৌভাগ্য আপনাকে বরকতময় করেছে। আপনি মারিফুল কুরআন তো পড়ে থাকবেন। মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ) এর সাবলীল তাফসির সহজলভ্য। মাদ্রাসায় পড়লে, জালালাইন পরীক্ষার খাতিরে হলেও পড়েছেন। শওক, যওক ও মনস্বিতা সহায়তা করলে, বয়ানুল কুরআন, তাফসিরুল কাবির ও আলুসির স্বাদ আপনি আস্বাদিত করেছেন। আপনি পত্রিকা বা ইন্টারনেটে হলেও ফি যিলালিল কুরআন পড়েছেন। তাফহিমুল কুরআন তো দেখে থাকবেন। সাফওয়াতুত-তাফসির খুবি জনপ্রিয়। সেটি আপনার অজানা নয়। ইয়াসির বা মুয়াসসিরও সরল সহজ। মোদ্দা কথা, আপনি কুরআনিক তাফসিরের ছোঁয়া ও পরশের মিষ্টতা পেয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ্। অন্তত কুরআনের তর্জমা পড়ে থাকবেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের অনুবাদ হলেও আপনি পড়েছেন। তাইনা?
যদি এসব সৌভাগ্য আপনাকে বরণীয় না করে, এখনি কুরআন ও তাফসিরের ছায়াতলে আশ্রয় নিন। কুরআন বিচ্ছিন্ন জীবন আসলে মৃত মৃগ। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
কুরআন মজিদের তাফসির হাদিস দিয়ে শুরু। পরে সাহাবা রিযওয়ানুল্লাহ আলাইহিম তা এক বিপুলকায় ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ করেছেন। ইবনু আব্বাস এর তাফসির প্রসিদ্ধ। সংক্ষেপে বললে, ইবনে কাসির ও কুরতুবি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও উপকারী মূল তাফসির।
বিশারদগণ তাফসিরকে দুইভাগে ভাগ করেছেন। রিওয়াইয়াহ্ ও দিরাইয়াহ্। হাদিস ও তাথ্যিক তাফসির রিওয়াইয়াহ্। দিরাইয়াহ্তে একটু গবেষণার ছাপ থাকে। একটু নবীশ ভাবনা থাকে। নতুন পর্যালোচনা থাকে। এরকম আর কি! ইমাম জামাখশারি ও রাজি (রহ) দিরাইয়াহ্ তাফসিরে ব্যাপক সমৃদ্ধকরণ আঞ্জাম দিয়েছেন। এর পূর্বাপর অবদান আপনার অজানা নয়। আলহামদুলিল্লাহ্।
আমি এখানে এক ভিন্নরকম তাফসিরের আলাপ করতে চেষ্টা করছি। তাফসিরের নাম_ তাদাব্বুরে কুরআন। উর্দু ভাষায় লিখিত একটি তাফসির। লেখক ইমাম আমিন আহসান ইসলাহি (রহ) (১৯০৪–১৯৯৭)
নাম শুনে বুঝতে পারছেন, এটি রিওয়াইয়াহ্ তাফসির নয়। আসলে এরকম নয়। এ তাফসিরে দিরাইয়াহ্ প্রচুর , সাথে রিওয়াইয়াও আছে।
তাদাব্বুর মানে, চিন্তা, গভীর অভিনিবেশ, গবেষণা ও অন্বেষণ। তাহলে, কুরআনের গভীরতম আলোচনাই এ কুরআনের বিষয়-আশয় হবে। হয়েছেও তাই। এটা নয় খণ্ডে লিখিতো তাফসির।
উর্দুতে লিখিত হলেও এটা বহুভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ইংরেজিতে দুর্দান্ত অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।আলহামদুলিল্লাহ্ ব্যাপক প্রশংসিত হয়ে সাড়া ফেলেছে তাফসির পাড়ায়।
এই তাফসির বিষয়ে উইকিপিডিয়া কী লিখেছে সম্যকভাবে পড়ুন!
Tadabbur-i-Qur’an (Urdu: تدبر قرآن) is a tafsir(exegeses) of the Qur’an by Amin Ahsan Islahi based on the concept of thematic and structural coherence।
অর্থাৎ কুরআন মজিদের বিন্যাস ও সংযুক্তির সৌন্দর্যরূপ খোলাসা করার নিরিখে এ তাফসির সুগঠিত হয়েছে।
বিষয়টি আরো সহজ করে বুঝাতে হবে। আমার কাছেও ঝাপসা লাগছে। কুরআনের তাফসিরে আয়াতের সাথে আয়াতের সম্বন্ধ, সুরার সাথে সুরার সম্পর্ক ও পুরো কুরআনিক মেসেজের নেপথ্য রসায়নকে নাজমুল কুরআন বলা হয়। এটা বলাগত তথা উচ্চস্তরের সাহিত্য পরিভাষা, তবে এটা আমাদের সাধারণ সাহিত্য ও ভাষায় বিদ্যমান। সমালোচনা সাহিত্যে মূলতঃ এসব নিয়ে দশদিশি আলোকপাত করা হয়।
এখন কুরআন মজিদের এই নাজমকে মূল্যায়ন করা হবে কিনা এটা একটা আলোচনার বিষয়। বেশির ভাগ মুফাসসির এটাকে এড়িয়ে গেছেন। কেউ কেউ এটা নিষ্প্রয়োজন বলেছেন। তাদাব্বুরের লেখক ইমাম ইসলাহি (রহ) স্বীয় উস্তাজ ইমাম হামিদুদ্দিন ফরাহি (রহ) এর(১৮৬৩–১৯৩০) মতানুসারী ছিলেন। ইমাম ফরাহি (রহ) চিন্তা দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত ইমাম ইসলাহি(রহ) নাজমুল কুরআনকে জরুরি মানতেন। তার প্রতিফলন তাদাব্বুরের পাতায় পাতায় বিদ্যমান।
তাদাব্বুর উর্দু ভাষায় সুলিখিত। তবে সাধারণ উর্দু থেকে তাঁর ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। অতুল সুন্দর ও কিছুটা জটিল ভাষায় তিনি তাফসির করেন। আসলে জটিলতা নয়, তাঁর ভাবসম্পদ একটু ভারি ও একেবারে নতুন। এজন্য একটু নতুনত্ব ছাওয়া শব্দ ও বাক্যের সমাহার।
পড়তে শুরু করলে, সহজ ও সরস হয়ে আসে। আলহামদুলিল্লাহ্।
আর উর্দু সাহিত্যে মাওলানা আজাদ (রহ) এর ভাষাবিন্যাসে পর ইমাম ইসলাহি (রহ) এর ভাষা নিজকীয়তায় অনন্য এক ভাষা।
এই তাফসিরের অনন্য বৈশিষ্ট্যাবলী সংক্ষেপে বলি?
- এই তাফসিরের তর্জমা একটু অন্যরকম। কুরআনের মেজাজ ও আরবির স্বভাবকে উর্দু ভাষার পোশাক পরানোর মতন। আপনি তাদাব্বুরের তর্জমা পড়লে, একটু অবাক হবেন, একটু ভাবনায় পড়বেন। এবং অন্যরকম ভালোলাগায় প্রীত হবেন। ইনশাআল্লাহ।
- এখনতো তাফসির মানে বিভিন্ন মতামতের জমায়েত। অগ্রাধিকার বা তুলনামূলক আলোচনা হয় না। পাঠক কোন রায় বা গভীরতা পায় না। এই তাফসির ব্যতিক্রম। তিনি আপনাকে অনেক সম্ভাবনার আলোচনা করলেও একটা অধিক সম্ভাব্য তর্জমার কথা বলবেন। এবং আমতাআমতা করে বলবেন না। বেশ প্রতীতর সাথে বলবেন।
- এই তাফসিরে শব্দ ও বাক্যের ব্যুৎপত্তিগত, পরিবেশগত ও পরিভাষাগত যে অর্থ আলোচনা হয়েছে, তা আর কোন তাফসিরে হয়েছে, আমার জানা নেই। এমনকি ইবনু আশুরের আত্তাহরির ওয়াত্তানবিরেও এসব এতো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে আলোচিত হয় নি।
- এই তাফসিরে কুরআনের চ্যালেঞ্জ তথা ই’জাযকে ব্যাপকহারে প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কুরআন মজিদের প্রতি শব্দ, বাক্য, সুরা হতে মু’জিযার বয়ান ঠিকরে ঠিকরে বের হচ্ছে, তা আপনি তাদাব্বুর পড়লে মোহাবিষ্ট হয়ে অনুভব করবেন। বস্তুত, তাদাব্বুর পড়লে, ই’জাযের সকল স্তর বিষয়ক বিশদ জানাশোনায় আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন।
- তাদাব্বুর কুরআনের যে আলংকারিক সৌন্দর্যরূপ নিয়ে আলোচনা করেছে। সব জরুরি। মেদহীন ঝরঝরে আলোচনা। বিশাল আলোচনার স্তূপ তাদাব্বুরে নেই। যা আছে, সবি অতি মূল্যবান। কুরআন পড়ার ব্যাপক সুখের এক কুঞ্জবন তাদাব্বুর।
- তাদাব্বুর আল্লাহর সম্বোধনগুচ্ছকে অতি গুরুত্ব দিয়ে তাৎপর্য ও ভাষাবোধের বিশ্লেষণ করেছে। যা আর কোন তাফসিরে এই নিবিড় আঙ্গিকে আমি পাই নি।
- কুরআন মজিদের মূলবার্তাকে বিভাজিত করে উসুল ও ফুরুসহ সুন্দর আলোকপাত করেছে তাদাব্বুর। কুরআনের মূল বিষয় ও তার শাখিকার এমন নিপুণ ও গোছাল ব্যাখ্যা সত্যি দুর্লভ।
- তাদাব্বুর হাদিস নিয়ে আলাপ করে। হাদিসের উপর মনোজ্ঞ আলাপ করে জরুরি ও বিশুদ্ধ হাদিসসহ কুরআনের তাফসিরকে বর্ণাঢ্য করে।
- তাদাব্বুর কুরআন মজিদকে কুরআনকে সর্বাধিকার দিয়ে তাফসির করে। এটা যদিও অনেকে করেছেন। তবু, তাদাব্বুর অনবদ্যতায় সমুজ্জ্বল।
- তাদাব্বুর নাজমুল কুরআন তথা আয়াত পরম্পরার যুক্তিসম্মত বিশ্লেষণ করে। অসাধারণভাবে নাজমকে কুরআন বিবৃত করে। কতো মজাদার! সে আপনি পড়লে, উপভোগ করবেন।
- তাদাব্বুর ফিকাহ নিয়েও আলোচনা করেছে। তবে, তা একটু গভীরতর, একটু জটিল। কুরআন মজিদের তত্ত্বের মূলে গিয়ে মুক্তো নিয়ে আসে তাদাব্বুর।
- তাদাব্বুর ইলমুল কালাম তথা দর্শনগত আলাপও করেছে। দার্শনিকতার ধাতু উল্টেপাল্টে তাদাব্বুর কুরআনিক দর্শন তুলে ধরেছে। এটা সত্যি, ব্যাপক সুন্দর! ও প্রণোদিত আলাপ!
- তাদাব্বুর মানুষের সহজাত আচার আচরণ ও কুরআন মজিদের বার্তা বিষয়ক খুব মনোগ্রাহী আলাপ করে। আবার মানুষের স্বভাব নিয়ে অস্বাভাবিক হৃদয়গ্রাহী তথ্যছক এঁকে দেখিয়েছে।
- তাদাব্বুর পুরনো আসমানি কিতাবগুচ্ছের গবেষণা, তত্ত্বতালাশ করে কুরআনের সাথে সাদৃশ্যগুলোর একটা বুঝাপড়া করেছে। যা অন্যান্য তাফসিরে আমরা পাই না।
- তাদাব্বুর আমাদের মনে আসা বিভিন্ন প্রশ্নাবলী, শয়তানি ওয়াসওয়াসার সাজানো গোছানো ও যৌক্তিক জবাবমালা পরিবেশন করেছে। এই তাফসির পড়লে, মন শীতল ও প্রশান্ত হয়ে আসে।
- তাদাব্বুরে কুরআন পড়ার পর আল্লাহ হেদায়ত কপালে রাখলে, আল্লাহ, রাসুল আলাইহিস সালাম ও ইসলামকে সহীহ রূপে মানা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
তাদাব্বুর পড়ার পর আপনি ও আমি একটু ভিন্নতর আমরা হয়ে যাব। এটাই এই তাফসিরের প্রভা ও প্রভাব।
আপনার আমার কুরআন প্রেম বেড়ে যাবে। কুরআন নিয়ে ভাবতে ও পড়তে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। কুরআনিক জীবনযাপন আমাদের আপ্লুত করবে। কুরআনের তাদাব্বুর আমাদেরকে সজাগ্রত ও সচকিত করবে। ইনশাআল্লাহ।
বস্তুত, মানুষ দুই প্রকার। যারা তাদাব্বুর পড়ে নি। যারা তাদাব্বুর পড়েছে। তাদাব্বুর পড়া ও বুঝা লোকজন একটু ব্যতিক্রম হয়। একটু ভিন্নতর কুরআন প্রেমী হয়।
আরো তাফসির পড়ুন। তাদাব্বুর পড়ুন। আজ অথবা কোন একদিন।
ইলাহি, আমাদের কুরআনের ছায়াতলে জীবন ও মরণ দান করুন।
আমিন!