প্রথম বিষয় হচ্ছে, কুরআন মাজীদ যে ভাষায় নাযিল হয়েছে, তা উম্মুল কুরা [বা মক্কার] উচ্চ আলংকারিক আরবী, যে ভাষায় জাহেলী যুগের কুরাইশ গোত্রের লোকেরা কথা বলতো। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআ’লা তাঁর [নাযিলকৃত] গ্রন্থে এ ভাষাকে দিয়েছেন অলংকার ও বাগ্মিতার এক চিরন্তন মুজেজা, তথাপি ভাষার সারবত্তার দিক থেকে এ ভাষায় কথা বলেছেন ¯্রষ্টার প্রেরিত নবী এবং এটা ছিল তৎকালীন মক্কাবাসীর ভাষা।
فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ الْمُتَّقِينَ وَتُنذِرَ بِهِ قَوْمًا لُّدًّا
“আর (হে নবী) আমরা এ কুরআনকে তোমার ভাষায় এজন্য সহজ ও প্রাঞ্জল করে দিয়েছি, যেন এর মাধ্যমে আপনি আল্লাহকে ভয়ে ভীত লোকদের সুসংবাদ প্রদান করতে পারেন এবং এর মাধ্যমে হঠকারী চরিত্রের লোকদের হুশিয়ার করে দিতে পারেন।” (সূরা মারইয়াম ১৯:৯৭)
এ কারণে কুরআনের উপলব্ধি এ ভাষার সঠিক জ্ঞান ও যথাযথ মেজাজ ও ভাষারূচির উপর নির্ভরশীল। কুরআনের গভীর উপলব্ধি অথবা এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্য যেকোনো ব্যক্তির জন্য আবশ্যক যে, তিনি এ ভাষার পাকাপোক্ত পণ্ডিত হবেন এবং নিজের মাঝে আরবী ভাষারীতির এমন অন্তরঙ্গ মেজাজ ও ভাষারূচি তৈরি করবেন যে, অন্ততপক্ষে ভাষার দিক দিয়ে কুরআনের উদ্দেশ্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে তিনি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবেন না। এ হাকিকতের এর চেয়ে অধিক আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। অধিকন্তু, এ ভাষার ক্ষেত্রে প্রত্যেক জ্ঞানান্বেষীর মাথায় এ বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে গেঁথে নিতে হবে যে, এই আরবী হুবহু হারীরী বা মুতানাব্বী কিংবা যামাখশারী বা রাযীর লেখা আরবী নয়; এবং একইসাথে তা আজকের দিনের মিশর বা সিরিয়ার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কিংবা এসব এলাকার সাহিত্যিক ও কবিদের কলম থেকে উৎসারিত আরবী নয়। হ্যাঁ, এগুলোও এক ধরনের আরবী; তবে কুরআন যে আরবীতে নাযিল হয়েছে, যেটাকে আরবী মুআল্লা বা উচ্চ আলংকারিক আরবী বলাই শ্রেয়, সেটার সাথে ভাষারীতি, গঠন এবং শব্দ ও বাগ্ধারার দিক দিয়ে এ আরবীর সাথে কম-বেশি যে পার্থক্য রয়েছে, তার উপমা: মীর ও গালীব এবং সাদী ও খাইয়্যামের ভাষার সাথে আমাদের এ যুগে হিন্দুস্তান ও ইরানের সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশিত উর্দু ও ফারসীর মধ্যকার পার্থক্যের ন্যায়। হাকিকত হচ্ছে: [আধুনিক ও মধ্যযুগীয়] এ আরবী না কুরআনের ভাষার প্রতি আপনার রূচিবোধ তৈরি করে, বরং তা ওই রূচিবোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় এবং যিনি এ ধরনের আরবীতে সম্পূর্ণ মশগুল হন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি কুরআনের উপলব্ধি থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হন।
ফলশ্রুতিতে কুরআনের ভাষার জন্য সর্বাগ্রে যে জিনিসের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে, তা স্বয়ং কুরআন মাজীদ। এ হাকিকত কেউই অস্বীকার করতে পারবে না যে, এ কুরআন যখন মক্কাতে নাযিল হচ্ছিল, তখন এর ঐশ^রিক মর্যাদার ব্যাপারে দীর্ঘ একটা সময় বিতর্ক চললেও কেউই এর আরবী নিয়ে কখনো কোনো চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি। এমনটি বলা হয় যে, এ কুরআন কোনো অনারব ব্যক্তির কাজ হতে পারে না এবং এ ব্যাপারে দলীল পেশ করা হয়েছে যে, এটা নাযিল হয়েছে সর্বোত্তম প্রাঞ্জল আবরীতে। কুরআন নিজেকে পরিণত করেছে ভাষা ও সাহিত্য এবং অলংকার ও বাগ্মিতার এক মুজেজায় এবং সেইসাথে কুরাইশদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিয়েছিল এর অনুরূপ একটি সূরা বানানোর চ্যালেঞ্জ। এখানেই থেমে থাকেনি, বরং প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে, এ কাজে সহায়তার জন্য তারা তাদের সাহিত্যিক, বক্তা, কবি, গণকসহ শুধু মানুষ নয় বরং প্রয়োজনে জীন, শয়তান ও দেব-দেবীদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তাকে শামিল করার সুযোগ তাদের রয়েছে। কিন্তু এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা অস্বীকারের কোনো অবকাশ নেই যে, আরববাসীদের মধ্য থেকে না কোনো ব্যক্তি কুরআনীয় ভাষার শানকে প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছে, আর না এর চ্যালেঞ্জ দেয়াটা কারো জন্যে কখনো সম্ভবপর হয়েছে।
“(এটা এ গ্রন্থের আহ্বান, তাই এ আহ্বানে সাড়া দাও), আর যা কিছু আমরা আমাদের বান্দার উপর নাযিল করেছি, তার ব্যাপারে তোমরা যদি সন্দেহে থাকো (তাহলে যাও) এবং এর মতো একটি সূরা বানাও, আর (এ জন্যে) আল্লাহ ছাড়া তোমাদের যে যে সহযোগী আছে, তাদের ডাকো, যদি (তোমরা তোমাদের এ ধারণায়) সত্যবাদী হয়ে থাকো।” (সূরা বাকারা, ২:২৩)
“বলে দাও: আর যদি গোটা মানব ও জীনজাতি একত্র হয়ে বানাতে চায় এ কুরআনের মতো কিছু একটা, তবে এ কুরআনের ন্যায় কিছুই তারা নিয়ে আসতে পারবে না, এমনকি তারা যদি একে অপরের সহযোগী পর্যন্ত হয়।” (সূরা বনী ইসরাঈল, ১৭:৮৮)
উপরন্তু, উম্মুল কুরা তথা মক্কার ওলীদ ইবনে মুগীরার ন্যায় সাহিত্য সমালোচক যখন কুরআনের ভাষা শ্রবণ করে, তখন স্বতস্ফূর্তভাবে বলে উঠে:
“আল্লাহর কসম, তোমাদের মধ্য থেকে না কেউ আমার থেকে বেশি কবিতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, না রণ-সংগীত, না স্তুতি কাব্য সম্পর্কে, আর না জীন দ্বারা অনুপ্রাণিত মন্ত্রের বিষয়ে। আল্লাহর কসম, এ লোকের কণ্ঠে যা ধ্বণিত হচ্ছে, তার কিছুই এসবের সাথে সাদৃশ্য রাখে না। আল্লাহর কসম, এ লোকের বলা বাণী বেশ সুমিষ্ট এবং বড়ই চমকপ্রদ। এর শাখা ফল-ফলাদিতে ভারী, আর শিকড়ও বেশ তরতাজা। বিজয় এর সুনিশ্চিত, পরাস্ত হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এর চেয়ে নি¤œতর সবই এর দ্বারা হবে বিধ্বস্ত।” (আস-সীরাতুন নববীয়্যাহ, ১ম খণ্ড: পৃষ্ঠা: ৪৯৯)
সাবআ’ মুয়াল্লাকাতের অন্যতম কবি লাবীদ ওই সময় জীবিত ছিল। লাবীদ এমনই উঁচু মাপের কবি ছিলেন যে, ফারাযদাকের মতো প্রথিতযশা কবিও তার একটি পংক্তির সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে ছিল। সেই লাবীদ কুরআনের ভাষার সামনে এমনই হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল যে, যখনই সায়্যিদিনা উমর ফারুক তার কাছে কবিতা শোনার আর্জি পেশ করেন, তখন তিনি বলেন: বাকারা ও আলে-ইমরানের পর কবিতা কী জিনিস?
এটা কেবল এক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি নয়; বরং এর তাৎপর্য হচ্ছে: গোটা আরবের অলংকার ও বাগ্মিতা পরাজয় বরণ করেছে কুরআনের ভাষার মাহাত্মের সামনে।
উপরন্তু, এটাও প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা যে, সামান্যতম পরিবর্তন এবং কোনো একটি অক্ষরের হেরফের ছাড়াই ভাষা ও সাহিত্যের এ বিস্ময় আমাদের নিকট একেবারে আক্ষরিকভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে। আর এ কারণে, এ হাকিকত সর্বজনগ্রাহ্য যে, আল্লাহর জমিনের উপর এ কুরআন কেবল দ্বীনের চ‚ড়ান্ত প্রমাণ নয়, বরং নিজ যুগের ভাষার ব্যাপারে এটাই চ‚ড়ান্ত ফয়সালাকারী ও সুস্পষ্ট দলীল।
কুরআন মাজীদের পর এ ভাষা নবীর হাদীস ও সাহাবীদের বর্ণনা ভাণ্ডারে পাওয়া যায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রেওয়ায়েত বিল মা’না তথা নবীর কথা ও সাহাবাগণের বাণী হুবহু শাব্দিকভাবে তুলে ধরার পরিবর্তে বর্ণনাকারী নিজ ভাষায় সেসবের মর্ম বর্ণনার কারণে এ ভাণ্ডারের গুলোর খুব সামান্য অংশই ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় নমুনা ও প্রমাণক হিসেবে উপস্থাপনযোগ্য। তথাপি এ ভাণ্ডারের যতটুকু অংশ হুবহু শাব্দিক বর্ণনা হিসেবে অবশিষ্ট আছে, তা [কুরআনীয় ভাষার] মেজাজে গঠিত মননের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান রত্ন। এ ভাষা আরব ও অনারবের মাঝে সবচেয়ে স্পষ্টভাষী নবী মুহাম্মদ ও সাহাবীগণের প্রাঞ্জল বাকরীতি; এবং শব্দ-বাগ্ধারা ও ভাষারীতি বর্ণনার দিক দিয়ে এটা ওই ভাষার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা, যাতে কুরআন নাযিল হয়েছিল। নবী [صلی اللہ علیہ وسلم]-এর দুআ, উপমা ও সাহাবীগণের সাথে তার কথোপকথন সাধারণভাবে রেওয়ায়েত বিল লাফয তথা বর্ণনাকারী দ্বারা হুবহু শাব্দিকভাবে বর্ণিত হয়েছে, আর এ কারণে কুরআনীয় ভাষার অধিক নমুনা এসব রেওয়ায়েতে পাওয়া যায়। ফলশ্রুতিতে, কুরআনের ভাষার শিক্ষার্থী যদি এই ভরা সমুদ্রজলে ডুব দেয়, তবে সে বহু মণি-মুক্তা সংগ্রহ করতে সমর্থ হবে; এবং কুরআনের শব্দ ও অর্থের নানা জটিলতা নিরসনে এ ভাণ্ডার থেকে বিপুল সহায়তা লাভে সক্ষম হবে।
এরপর এ ভাষার সবচেয়ে বড় উৎস আরবী সাহিত্য। এটা ইমরুল কায়েস, যুহায়ের, আমর ইবনে কুলছুম, লাবীদ, নাবিগা, তারাফা, আনতারা, আ’শা ও হারিছ ইবনে হালিযার ন্যায় কবি এবং কুস ইবনে সায়িদার ন্যায় বক্তার ভাষা। বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ জানে যে, এ সাহিত্যের বড় অংশ কবিদের দিওয়ান তথা কাব্য সংকলনে এবং “আসমায়িয়াত”, “মুফাদ্দিলিয়াত”, “হামাসা”, “সাবআ’ মুয়াল্লাকাত” এবং জাহিয ও মুর্বারাদের মতো অন্যান্য সাহিত্যিকের লিখিত গ্রন্থে সংরক্ষিত আছে। বর্তমান সময়ে জাহেলী কবিদের বহু দিওয়ান প্রকাশিত হয়েছে, যা পূর্বে প্রকাশ পায়নি। এতে সন্দেহ নেই যে, আরবী ভাষার অধিকাংশ শব্দ ভাণ্ডার ওই ভাষাভাষীদের ইজমা ও তাওয়াতুরের মাধ্যমে [আমাদের পর্যন্ত] পৌঁছেছে এবং এ শব্দ ভাণ্ডারের প্রধান উৎস: “তাহযীব”, “আল-মুহকাম”, “আস-সিবাহ”, “আল-জামহুরা” ও “আন-নিহায়া” -সহ অন্যান্য গ্রন্থে সংরক্ষিত রয়েছে। তথাপি এর সাথে এটাও বাস্তবতা যে, আরবী শব্দ ভাণ্ডারের যে অংশ এমন মুতাওয়াতির নয়, সে অংশের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রমাণিক দলীলও আরবী সাহিত্য। এর মাঝে যদি কোনো জিনিসের সংযোজনও ঘটে, তবে ঠিক যেভাবে হাদীসের সমালোচক পণ্ডিতগণ বিশুদ্ধ ও দুর্বল বর্ণনার মাঝে পার্থক্য করতে পারেন, সেভাবে বর্ণনাসূত্র ও মূলপাঠের সুস্পষ্ট মানদণ্ডের আলোকে ভাষা সমালোচকগণ শুদ্ধ ও অশুদ্ধ জিনিস একে অপর থেকে আলাদা করতে সক্ষম। ফলশ্রুতিতে, শব্দ ও সাহিত্যের বিদগ্ধ পণ্ডিতগণ সর্বদা এ ব্যাপারে একমত যে, কুরআনের পর এই সাহিত্যের উপর নির্ভর করা যায়; এবং বর্ণনা পরম্পরার শুদ্ধতা ও রেওয়ায়েত বিল লাফয দ্বারা বর্ণিত হওয়ায় ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় এ সাহিত্য নমুনা ও প্রমাণকের মর্যাদা রাখে। “খাযানাতুল আদাব” গ্রন্থের রচয়িতা লিখেন:
“যে বক্তব্য দ্বারা ভাষার ক্ষেত্রে প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়, তা দু’ ধরনের। প্রথমটি কবিতার আদলে পাওয়া যায় এবং অপরটি কবিতা ভিন্ন অন্য জিনিস। প্রথম প্রকারকে বিজ্ঞ পণ্ডিতগণ চার শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। প্রথম শ্রেণিতে রয়েছে: ইসলাম পূর্ব জাহেলী কবিগণ, যেমন: ইমরুল কায়েস ও আ’শা। দ্বিতীয় শ্রেণিতে আছে মুখদারামুন কবিগণ অর্থাৎ যারা ইসলাম ও জাহেলী উভয় যুগ পেয়েছেন, যেমন: লাবীদ ও হাসান। তৃতীয় ভাগ মুকাদ্দিমুন কবিগণ অর্থাৎ যেসব কবি ইসলামের প্রথম দিকে ছিলেন, এজন্য এদের ইসলামীয়ুনও বলা চলে, যেমন: জারীর ও ফারাযদাক। চতুর্থ ভাগে আছেন মুওয়াল্লিদুন কবিগণ, এদের মুহাদ্দিছুনও বলা চলে। এ ভাগে ওইসব কবি শামিল, যারা প্রথম তিন শ্রেণির কবিদের পর আমাদের যুগ পর্যন্ত জন্মেছেন, যেমন: বাশার ইবনে বারদ ও আবু নুওয়াস। প্রথম দু’ শ্রেণির ব্যাপারে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত যে, ভাষার প্রামাণিকতা সাব্যস্তকরণে কেবল এই কবিদের কবিতাই গ্রহণযোগ্য।” (১ম খণ্ড: পৃষ্ঠা: ৩)
এ কথাটুকু সায়্যিদিনা উমর ফারুক [رضی اللہ عنہ] নিজ মিম্বার থেকে মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে বলেন:
“হে লোক সকল, তোমরা নিজেদের দিওয়ান অর্থাৎ জাহেলী কবিতার সংরক্ষণে মনোযোগী হও। কেননা সেগুলোতে রয়েছে তোমাদের গ্রন্থের ব্যাখ্যা এবং তোমাদের ভাষার মর্ম।” (আনওয়ার আত-তানযীল ওয়া আসরারুত তাবীল, ৩য় খণ্ড: পৃষ্ঠা: ৪০১)
সাহাবাগণের মাঝে অত্যন্ত প্রাজ্ঞ পণ্ডিত ইবনে আব্বাস [رضی اللہ عنہ] বলেন:
“কুরআনের কোনো জিনিসি যদি তোমাদের নিকট স্পষ্ট মনে না হয়, তবে ওইসব (জাহেলী) কবিতার মাঝে তার মর্ম তালাশ করো। কেননা বাস্তবিকপক্ষে এগুলো আরববাসীর দিওয়ান বা কাব্যগ্রন্থ।” (মুসতাদরাক আল-হাকিম, হাদীস নং: ৩৮৪৫)
এ বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে যে, জাহেলী সাহিত্য কেবল আরবী ভাষা ও এর বাকরীতির উৎসই নয়, বরং সেইসাথে তা আরব সমাজ-সংস্কৃতির ও সভ্যতার প্রতিফলন। এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকলে কুরআন মাজীদের নির্দেশনা, সূক্ষ্ম ইশারা ও প্রশ্ন-উত্থাপন, রূপক ব্যবহার রীতি উপলব্ধিতে সমস্যায় পতিত হবে, যা এই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের প্রধান উপাদান। আরব সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ কী? ওই সমাজ কোন জিনিসগুলোকে মারূফ [ভাল কাজ] এবং কোন জিনিসগুলোকে মুনকার [অসৎ কর্ম] বিবেচনা করে? ওই সমাজে ভাল ও মন্দের মাপকাঠি কী? তাদের ধর্ম, আচার ও প্রথা-রেওয়াজের ধরন কী? তাদের সমাজ কী কী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের সমাজ কী কী উপাদান দ্বারা গঠিত হয়েছে? তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কিসে তারা প্রতিদিন সম্পৃক্ত ও কর্মব্যস্ত থাকে? তারা কী বন্য জানোয়ারের ন্যায় অসভ্য জাতি ছিল, যাদেরকে ইসলাম উপরে উঠিয়ে দুনিয়ার ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছিল? কিংবা এমন বুনো আচরণ সত্ত্বেও বিশেষ কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী জাতি হওয়ার সুবাদে তাদেরকে কুরআনের মতো গ্রন্থ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহর তরফ থেকে গোটা দুনিয়ার জন্য সত্যের সাক্ষ্য দেয়ার মতো মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন? এগুলো ওইসব প্রশ্ন, যেগুলো সঠিক উত্তর এ সাহিত্যে পাওয়া যায় এবং এখানে পাওয়া উত্তরের আলোকে কুরআন মাজীদের নির্দেশনা, সূক্ষ্ম ইশারা ও প্রশ্ন-উত্থাপন, রূপকতা কুরআনের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের নিকট স্বীয় সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও মর্মার্থের পূর্ণতার বিচারে স্পষ্ট হতে থাকে।
ফলশ্রুতিতে, এটা কেবল ভাষার বিষয় নয়, বরং কুরআনের শিক্ষার্থীদের জন্য আবশ্যক হচ্ছে: এসব বিষয়ে [বুৎপত্তি লাভের] জন্য এ সাহিত্যে বারবার প্রত্যাবর্তন করা।
ভাষার অলংকার
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে: কুরআন কেবল আরবী নয়, বরং তা বোধগম্য আরবীতে নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ এমন এক ভাষা, যা অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং যাতে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা ও ভাসাভাসা কিছু নেই। যার প্রতিটি শব্দ পরিষ্কার এবং নিজ শ্রোতাদের নিকট যার প্রতিটি বাকরীতি অতীব পরিচিত। আল্লাহ তাআ’লা বলেন:
“আপনার অন্তরের উপর এটা অবতীর্ণ হয়েছেন রুহুল আমীন, যেন আপনি হন অন্য নবীগণের ন্যায় সতর্ককারী; অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল আরবী ভাষায়।” (সূরা শুআরা, ২৬: ১৯৩-১৯৫)
“এই কুরআনে যে আরবী ভাষা বিবৃত হয়েছে, তাতে নেই কোনো বক্রতা, এটা এজন্য যে তারা [এর মাধ্যমে] আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পায়।” (সূরা যুমার, ৩৯:২৮)
কুরআনের ব্যাপারে এটা সুস্পষ্ট বাস্তবতা। এটা মেনে নেয়ার সাথে এ বিষয় গ্রহণ করা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায় যে, কুরআনের কোনো শব্দ বা বাকরীতি অর্থের দিক থেকে বিরল বা অপরিচিত হতে পারে না। নিজ শ্রোতাদের দিক থেকে কুরআন সম্পূর্ণ পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত চেনা শব্দ ও বাকরীতিতে নাযিল হয়েছে। ভাষার দিক থেকে কুরআনের কোনো বিষয়ে কোনো ধরনের দুর্বোধ্যতা নেই; বরং প্রতিটি দিক থেকে তা প্রাঞ্জল ও সুস্পষ্ট। এ কারণে কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যার প্রতিটি ক্ষেত্রে এর শব্দের সুপরিচিত অর্থ চয়ন বিবেচনায় রাখতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো বিশ্লেষণ প্রদান করলে তা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ یَسْجُدٰنِ আয়াতটির ‘النَّجْمُ’ শব্দের অর্থ কেবল ‘তারা’-ই হবে।
اِلَّآ اِذَا تَمَنّٰی আয়াতটির ‘تَمَنّٰی’ শব্দের মর্ম ‘কামনা’ ও ‘বাসনা’ হবে।
اَفَلَا یَنْظُرُوْنَ اِلَی الْاِبِلِ আয়াতটির ‘الْاِبِل’ শব্দ ‘উট’ বোঝাতে এসেছে।
کَاَنَّھُنَّ بَیْضٌ مَّکْنُوْنٌ আয়াতটির ‘بَیْض’ শব্দের অর্থ ‘ডিম’ হবে।
فَصَلِّ لِرَبِّکَ وَانْحَرْ আয়াতটির ‘اِنْحَر’ শব্দ দ্বারা ‘কুরবানী’ উদ্দেশ্য।
এ শব্দগুলোর অর্থ যথাক্রমে ‘চারাগাছ’, ‘তিলাওয়াত’, ‘মেঘ’, ‘ডিমের মাঝে লুকানো ঝিল্লি’ এবং ‘বুকের উপর হাত বাঁধা’ অর্থ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। শব্দের ন্যায় ই’রাব বা বিভক্তি ও অলংকার রীতির বিষয়টিও অনুরূপ। আরবী ব্যাকরণ ও অলংকার শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ এ শাস্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত কুরআনের বহু জিনিসকে অপ্রচলিত ও ব্যতিক্রম সাব্যস্ত করলেও বাস্তবতা হচ্ছে: এমন উপসংহার ব্যাপক গবেষণার ঘাটতি ও কম অনুসন্ধানের ফসল। আমাদের সময়কার ‘মাদরাসায়ে ফারাহী’ তথা ফারাহী চিন্তাধারার প্রখ্যাত দুই মনীষী ইমাম হামিদুদ্দীন ফারাহী ও উস্তাদ ইমাম আমীন আহসান ইসলাহী কুরআন মাজীদের ভাষা নিয়ে যে কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন, তাতে এই বাস্তবতা পুরোপুরি স্পষ্ট যে, এসব ক্ষেত্রে কুরআন মাজীদে যে বাকরীতি অনুসৃত হয়েছে, সেটাই আরবী ভাষার প্রচলিত ও সুপরিচিত বাকরীতি। কুরআনের যেসব শিক্ষার্থী এসব বিষয়ে বিস্তর আগ্রহ ও রূচিবোধ রাখে, তারা এই ধারাবাহিকতায় ইমাম ফারাহী’র “মুফরাদাতুল কুরআন”, “আসালিবুল কুরআন”, “জামহুরাতুল বালাগা”, “মাজমুয়ায়ে তাফাসীর” এবং উস্তাদ ইমাম আমীন আহসান ইসলাহী’র “তাদাব্বুরে কুরআন”-এ নিজেদের জন্য বহু মূল্যবান দিক-নির্দেশনা লাভ করবে। কুরআনের ব্যাখ্যায় এই মূলনীতির অনুসরণ এটার ভাষার অলংকারের দাবী এবং এটার ভাষাতাত্ত্বিক ভাষার অলংকার নিয়ে উপরে যা আলোচিত হয়েছে, তা স্বয়ং কুরআনের দলীল-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এটাকে পাশ কাটিয়ে কুরআনের যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই প্রদান করা হোক না কেন, তা কখনোই শুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।