দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে: কুরআন কেবল আরবী নয়, বরং তা বোধগম্য আরবীতে নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ এমন এক ভাষা, যা অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং যাতে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা ও ভাসাভাসা কিছু নেই। যার প্রতিটি শব্দ পরিষ্কার এবং নিজ শ্রোতাদের নিকট যার প্রতিটি বাকরীতি অতীব পরিচিত। আল্লাহ তাআ’লা বলেন:
“আপনার অন্তরের উপর এটা অবতীর্ণ হয়েছেন রুহুল আমীন, যেন আপনি হন অন্য নবীগণের ন্যায় সতর্ককারী; অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল আরবী ভাষায়।” (সূরা শুআরা, ২৬: ১৯৩-১৯৫)
“এই কুরআনে যে আরবী ভাষা বিবৃত হয়েছে, তাতে নেই কোনো বক্রতা, এটা এজন্য যে তারা [এর মাধ্যমে] আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পায়।” (সূরা যুমার, ৩৯:২৮)
কুরআনের ব্যাপারে এটা সুস্পষ্ট বাস্তবতা। এটা মেনে নেয়ার সাথে এ বিষয় গ্রহণ করা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায় যে, কুরআনের কোনো শব্দ বা বাকরীতি অর্থের দিক থেকে বিরল বা অপরিচিত হতে পারে না। নিজ শ্রোতাদের দিক থেকে কুরআন সম্পূর্ণ পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত চেনা শব্দ ও বাকরীতিতে নাযিল হয়েছে। ভাষার দিক থেকে কুরআনের কোনো বিষয়ে কোনো ধরনের দুর্বোধ্যতা নেই; বরং প্রতিটি দিক থেকে তা প্রাঞ্জল ও সুস্পষ্ট। এ কারণে কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যার প্রতিটি ক্ষেত্রে এর শব্দের সুপরিচিত অর্থ চয়ন বিবেচনায় রাখতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো বিশ্লেষণ প্রদান করলে তা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ یَسْجُدٰنِ আয়াতটির ‘النَّجْمُ’ শব্দের অর্থ কেবল ‘তারা’-ই হবে।
اِلَّآ اِذَا تَمَنّٰی আয়াতটির ‘تَمَنّٰی’ শব্দের মর্ম ‘কামনা’ ও ‘বাসনা’ হবে।
اَفَلَا یَنْظُرُوْنَ اِلَی الْاِبِلِ আয়াতটির ‘الْاِبِل’ শব্দ ‘উট’ বোঝাতে এসেছে।
کَاَنَّھُنَّ بَیْضٌ مَّکْنُوْنٌ আয়াতটির ‘بَیْض’ শব্দের অর্থ ‘ডিম’ হবে।
فَصَلِّ لِرَبِّکَ وَانْحَرْ আয়াতটির ‘اِنْحَر’ শব্দ দ্বারা ‘কুরবানী’ উদ্দেশ্য।
এ শব্দগুলোর অর্থ যথাক্রমে ‘চারাগাছ’, ‘তিলাওয়াত’, ‘মেঘ’, ‘ডিমের মাঝে লুকানো ঝিল্লি’ এবং ‘বুকের উপর হাত বাঁধা’ অর্থ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
শব্দের ন্যায় ই’রাব বা বিভক্তি ও অলংকার রীতির বিষয়টিও অনুরূপ। আরবী ব্যাকরণ ও অলংকার শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ এ শাস্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত কুরআনের বহু জিনিসকে অপ্রচলিত ও ব্যতিক্রম সাব্যস্ত করলেও বাস্তবতা হচ্ছে: এমন উপসংহার ব্যাপক গবেষণার ঘাটতি ও কম অনুসন্ধানের ফসল। আমাদের সময়কার ‘মাদরাসায়ে ফারাহী’ তথা ফারাহী চিন্তাধারার প্রখ্যাত দুই মনীষী ইমাম হামিদুদ্দীন ফারাহী ও উস্তাদ ইমাম আমীন আহসান ইসলাহী কুরআন মাজীদের ভাষা নিয়ে যে কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন, তাতে এই বাস্তবতা পুরোপুরি স্পষ্ট যে, এসব ক্ষেত্রে কুরআন মাজীদে যে বাকরীতি অনুসৃত হয়েছে, সেটাই আরবী ভাষার প্রচলিত ও সুপরিচিত বাকরীতি। কুরআনের যেসব শিক্ষার্থী এসব বিষয়ে বিস্তর আগ্রহ ও রূচিবোধ রাখে, তারা এই ধারাবাহিকতায় ইমাম ফারাহী’র “মুফরাদাতুল কুরআন”, “আসালিবুল কুরআন”, “জামহুরাতুল বালাগা”, “মাজমুয়ায়ে তাফাসীর” এবং উস্তাদ ইমাম আমীন আহসান ইসলাহী’র “তাদাব্বুরে কুরআন”-এ নিজেদের জন্য বহু মূল্যবান দিক-নির্দেশনা লাভ করবে। কুরআনের ব্যাখ্যায় এই মূলনীতির অনুসরণ এটার ভাষার অলংকারের দাবী এবং এটার ভাষাতাত্ত্বিক ভাষার অলংকার নিয়ে উপরে যা আলোচিত হয়েছে, তা স্বয়ং কুরআনের দলীল-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এটাকে পাশ কাটিয়ে কুরআনের যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই প্রদান করা হোক না কেন, তা কখনোই শুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।