হাদিস কি দ্বীনের মূল উৎস?
.বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। আসসালামু আলাইকুম …।
এক ভাই আমাকে ম্যাসেজ করে বলে, “তোমরা যারা হাদিস বাদ দিয়ে শুধু কুরআনকে ধর্মের মূল উৎস হিসেবে মানো তাদের জন্য রাসুল (সঃ) একটি সতর্কবাণী করে গিয়েছেন।” আর এই হাদিসটি বেশীরভাগ ভাইবোনেরা হাদিসকে ধর্মের মূল উৎস হিসেবে প্রমান করার জন্য পেশ করে থাকেন।
হাদিসটি হচ্ছে …
.উবাইদুল্লাহ ইবনু আবূ রাফি (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “অচিরেই তোমাদের মধ্যকার কোনো ব্যক্তি তার গদি আঁটা আসনে হেলান দিয়ে বসে থাকাবস্থায় তার নিকট আমার নির্দেশিত কোনো কর্তব্য বা নিষেধাজ্ঞা পৌঁছবে, তখন সে বলবে, আমি অবহিত নই। আমরা যা আল্লাহর কিতাবে পাবো শুধু তারই অনুসরণ করবো।”
(আবু দাউদ ৪৬০৫)
.এই হাদিসে রাসুল (সঃ) সতর্ক করে বলেছেন যে কুরআন যেভাবে মানতে হবে আমার কথাও সেইভাবেই মানতে হবে। আর অচিরেই তোমাদের মাঝে এমন লোক আসবে যারা আমার কথা শুনবে কিন্তু হেলান দিয়ে বসে থেকে অহংকারের সাথে সেটা অবজ্ঞা করবে আর বলবে আমরা কেবল কুরআনকেই মানি। … স্বাভাবিকভাবেই এই হাদিস যারা পড়বে তারা মনে করবে দ্বীনের প্রধান উৎস হিসেবে কুরআনের পাশাপাশি হাদিসকেও একইভাবে মানতে হবে। তা’নাহলে রাসুল (সঃ) তাদের ব্যাপারে এই সতর্কবাণী করে দিয়েছেন।
.সবার প্রথমে দ্বীন অন্বেষণকারী একজন মুসলিমের কাজ হচ্ছে হাদিসটি নিয়ে একটু যাচাই-বাছাই করা। এবং বুঝার চেস্টা করা যে হাদিসে আসলে কি বলা হচ্ছে । আমাদের মুহাদ্দিসগণ তেমনটাই করেছিলেন যখন উনারা হাদিস সংরক্ষণের কাজ করেছেন তখন যাচাই-বাছাই করে দেখেছেন হাদিসটি যে বলছে তার চরিত্র কেমন, তার সৃতিশক্তি কেমন। যেই হাদিসটি বলা হচ্ছে সেটা অন্য সাহাবী থেকে ভিন্নভাবে, ভিন্ন কথাতে আসছে কিনা, হাদিসটি কি কুরআন সুন্নাহর বিরোধি কিনা ইত্যাদি। সাধারণত একটি হাদিস অনেক ক্ষেত্রেই বহু সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়। সেক্ষেত্রে সবাই নিজের স্মরণশক্তি হিসেবে হাদিসটি প্রচার করে থাকে। কেউ হাদিসের কিছু অংশ প্রচার করে থাকে আবার কেউ পুরো হাদিসটি প্রচার করে।
.আমরা যখন এই হাদিসটি নিয়ে গবেষণা করলাম তখন দেখতে পেলাম এই একই হাদিস বহু সাহাবী থেকে অন্যান্য হাদিসের কিতাবেও বর্ণিত হয়েছে। এই একই হাদিস আরেকজন সাহাবী থেকেও বর্ণিত হয়েছে যেখানে হাদিসের শেষে আরো কিছু অংশ তিনি বর্ণনা করেছেন। যেমন রাসুল (সঃ) যখন সতর্ক করে কথাটি বলেছেন অতঃপর এটাও বলেছেন যে “আহলে কিতাবদের ঘরে প্রবেশ করবে না।”… একজন দ্বীন অন্বেষণকারী ইসলামের ছাত্রের কাছে এই প্রশ্নটা তখন চলে আসে যে রাসুলের (সঃ) পূর্বের এই সতর্কবাণীর পরে এই কথাটি বলার কারন কি যে ‘আহলে কিতাবিদের ঘরে প্রবেশ করবে না?’ যদি ধরেই নেই যে হাদিসের শুরুতে “যারা কুরআন মানবে আর হাদিস অস্বীকার করবে তাদের ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছে” তাহলে শেষে কেন রাসুল (সঃ) এটা বলছেন যে “আহলে কিতাবদের ঘরে প্রবেশ করবে না?”
যখন আরো গবেষণা করলাম তখন দেখলাম এই হাদিসটি আরো বড় হচ্ছে। ভিন্ন আরেক সাহাবী এই একই হাদিসের আরো কিছু অংশ শেষে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুল (সঃ) যখন বলেছেন “আহলে কিতাবিদের ঘরে প্রবেশ করবে না” অতঃপর তিনি আরো বলেছেন “তাদের নারীদের দিকে হাত বাড়াবে না, তাদের গাছের ফল ছিড়বে না, আর তাদের পশুদের জবেহ করবে না।” … এখন আরো প্রশ্ন চলে আসে যে আসলে কি হয়েছিলো ঐ সময়ে যেই কারনে রাসুল (সঃ) প্রথমে আমভাবে একটি ভবিষ্যতবাণী করছে কিন্তু শেষের দিকে স্পেসিফিক কিছু মানুষকে আদেশ-নিষেধ করেছেন? তাহলে কোন প্রেক্ষাপটে কাদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা হয়েছিলো?
তারপর খুঁজে পাওয়া গেলো যে আরেকজন সাহাবী থেকে হাদিসের কিতাবগুলোতেই এই পুরো হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে। যে হাদিসে প্রেক্ষাপট সহ পুরো হাদিসটি তুলে ধরা হয়েছে। কাদের উদ্দেশ্যে রাসুল (সঃ) এই কথা বলেছিলেন আর কেন বলেছে সেটাও বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি এমন যে … রাসুল (সঃ) যখন খায়বারের যুদ্ধের সময় সেখানে পৌঁছালেন তখন সেই গোত্রের সর্দার আল্লাহ্র রাসুলের (সঃ) কাছে আসলো। আর সে ছিলো খুব দাম্ভিক আর রাগি একজন সর্দার। সে তখন আল্লাহ্র রসূলকে (সঃ) উদ্দেশ্য করে বলল, হে মুহাম্মাদ ! তুমি চলে এসেছো যুদ্ধ করতে ? এখন তো তুমি আমাদের নারীদের মারবে, আমাদের ঘরগুলোতে প্রবেশ করবে, আমাদের মাল লুট করবে, আমাদের গাছের ফলগুলো নিয়ে নিবে, আর আমাদের পশুদের জবেহ করবে। সে এভাবে বলে অপবাদ দিয়ে বুঝাচ্ছিলো যে তোমরা এখন যুদ্ধ করতে এসেছো তারমানে আমাদের উপর এইভাবে হত্যা আর জুলুম করবে।
রাসুল (সঃ) সর্দারের এই কথাগুলো শুনে উনার চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেলো। তিনি রাগান্বিত হয়েছিলেন। কারন এগুলো রসুলের (সঃ) বিরুদ্ধে অপবাদ। তখন তিনি সাহাবীদের নিয়ে নামায পড়লেন। এবং নামাযের পর খুৎবা প্রদান করলেন। সেই খুৎবায় তিনি সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, মনে রেখো, ঐ ব্যক্তি ততোক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে যেতে পারবে না যতক্ষণ মুমিন না হবে। (এরমানে তোমরা আল্লাহ্র রসুলের সাথে যুদ্ধে চলে এসেছো বলে মনে করোনা যে জান্নাতে চলে যাবে। বরং জান্নাতের জন্য মুমিন হওয়া জরুরী)। তাই তোমরা মুমিন হও। এরপর ঐ সর্দার যে অপবাদ দিয়েছে সে উত্তরে সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বললেন “আমি তোমাদের বলছি, কেউ যাতে আহলে কিতাবদের ঘরে প্রবেশ না করে, কেউ যাতে তাদের পশু জবেহ না করে, তাদের নারীদের গায়ে হাত না দেয় আর তাদের গাছের ফল না ছিঁড়ে। আমি রসূল হিসেবে তোমাদেরকে এই আদেশ করলাম।”
… এরপর ঐ অংশটুকু রাসুল (সঃ) বললেন যেই অংশটুকু প্রথমে আমরা উপরে বলেছি যে এক ভাই আমাকে ম্যাসেজে পাঠিয়েছিলো। আরো মনে করিয়ে দেই যে প্রেক্ষাপটটি ছিলো খায়বারের যুদ্ধের ময়দানের। আর একটু পরেই যুদ্ধ করে জয়লাভ করবে মুসলিমরা আর মুসলিমদের ব্যাপারে খায়বারের সর্দারের এই নোংরা অপবাদের জবাবে রাসুল (সঃ) কথাগুলো বলেছিলেন। এরপর তিনি সাহাবীদের বললেন আমি দেখতে পাচ্ছি অচিরেই তোমাদের মধ্যে কিছু লোক গদিতে হেলান দিয়ে বসে থাকবে (মানে যুদ্ধে জয় লাভ করে গনিমতের মাল পেয়ে বসে থাকবে) , আর কেউ যখন তোমাদের বলবে এই কাজগুলো করো না। তখন যেন সে না বলে যে এই আদেশ তো কুরআন মাজিদে কোথাও নেই। তাই আমরা মানবো না। আমরা তো কুরআনে যা আছে সেটা মেনে চলছি ! ”আমি মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহ্র রসূল হিসেবে তোমাদের সতর্ক করছি , যেভাবে কুরআন মেনে চলা আমদের জন্য বাধ্যতামূলক তেমনি আমি তোমাদের কোন আদেশ-নিষেধ করলে সেটাও মেনে চলা তোমাদের উপর বাধ্যতামূলক।” (হাদিস / সুনানুল কুবরা ১৭২২৪)
.ভেবে দেখুন হাদিসটি কি ছিলো আর সেটা থেকে কি ব্যাখ্যা বের করে প্রচার করা হচ্ছে! রাসুল (সঃ) হাদিসে যেমনটা বলেছেন সেটা কুরআনের ঐ আয়াতের কথা যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন যখন কোন রসূল দুনিয়াতে আসে তখন তাকে সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে হয়। কুরআন মাজিদ এটাও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে যে, যখন রসূল তোমাদের মধ্যে কোন ফায়সালা করবে তখন অন্তরে কোন প্রকারের সংশয় ছাড়াই সেটা মেনে নিতে হবে। তারমানে আল্লাহ্র প্রেরিত রসুলের অনুসরন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একজন রসূল তাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে বলছে আহলে কিতাবদের ঘরে প্রবেশ করবে না, ফল ছিড়বে না, নারীদের হাত লাগাবে না, পশুগুলো জবেহ করবে না। এরপরে কিভাবে একজন মুসলিম আল্লাহ্র রসুলের আদেশ লঙ্ঘন করতে পারে ?
মূল কথা হচ্ছে, যারা কুরআনের বাইরে হাদিসকেও দ্বীনের মূল উৎস মনে করে আর স্বয়ং হাদিস থেকেই হাদিস মানার দলীল দেয় তাদের সেই হাদিসের অবস্থান কেমন সেটা আপনারা দেখলেন তো? যেখানে বলা হচ্ছে একটি কথা আর সেটাকে প্রেক্ষাপট থেকে সরিয়ে এনে কি হিসেবে পেশ করা হচ্ছে ! এ কারনেই আল্লাহ্র রসূল (সঃ) দ্বীনের কোন বিষয় দুই চার আটজনের কানে কানে প্রচার করেন নি। বরং পুরো কুরআন ও সুন্নাতগুলো সাহাবীদের কাছে দ্বীন হিসেবে স্পষ্ট করে পৌঁছে দিয়েছেন আর তারাও সেটা প্রতিদিনের আমল ও ঐকমতের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
হাদিস আমাদের কাছে মহা মূল্যবান সম্পদ, আমাদের মাথার তাজ, আমাদের অন্তরের প্রশান্তি, আর আমাদের প্রিয় রসুলের কথা কাজ ও জীবনী। এটাকে আমরা পড়বো, এবং কুরআন দিয়ে বুঝার চেষ্টা করবো। কুরআন হচ্ছে আমাদের জন্য দ্বীনের মূল মানদণ্ড। যা দিয়ে আমরা সব কিছু বিচার ফায়সালা করবো। এছাড়া আল্লাহ্র রসূল (সঃ) হাদিসকে আলাদাভাবে প্রচার করতে নিষেধ করেছেন। কারন এতে মানুষে চিন্তাভাবনা যোগ হয়ে পুরো দ্বীন পরিবর্তন হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে আরো অনেক হাদিস ও ভুল বুঝাবুঝি রয়েছে যেটার জন্য আলাদা পোস্ট করা হবে ইন শা আল্লাহ্। কুরআন হচ্ছে আমাদের মিজান (দাঁড়িপাল্লা), ফুরকান (সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের মানদণ্ড), হাকেম (ফায়সালাকারি), মুহাইমিন (অভিবাবক) ! কুরআনের ফিল্টারে আমরা মানুষের কথা বা হাদিসগুলো ফিল্টারিং করেই মেনে চলবো।
জনাব মুহাম্মাদ হাসান ইলিয়াস সাহেবের উর্দু আলচনা অনুবাদ
অনুবাদকঃ আরিফ আহমদ