সুন্নাহ ,হাদিস ও উসওয়ায়ে-হাসানা
রাসুল (স) বলে গিয়েছেন যে, আমি তোমাদের দুইটি জিনিস দিয়ে গিয়েছি।
১- কিতাবুল্লাহ অর্থাৎ কুরআন
২- সুন্নাহ
কেউ যদি এই দুইটি বিষয় দ্বীন-ইসলামের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রাখে তাহলে সে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না।
আজকের আলোচনায় আমরা সুন্নাহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে জানার চেষ্টা করব। এর পাশাপাশি হাদিস, উসওয়ায়ে-হাসানা এবং এই পরিভাষা গুলোর মধ্যে কি পার্থক্য রয়েছে তা জানব।
সুন্নাহ
দ্বীন-ইসলাম রাসুল (স) এর মাধ্যমে প্রথম শুরু হয়নি। তিনি সর্বশেষ নবী। পবিত্র কুরআন ইসলামের সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত আসমানী গ্রন্থ। কুরআন থেকে আমরা জানতে পারি রাসুল (স)-কে যে দ্বীন -ইসলাম দেওয়া হয়েছিলো তা নতুন কোন ধর্ম নয়। বরং সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ তায়ালা তার এই দ্বীন মানব জাতির নিকট প্রেরণ করেছিলেন। হযরত আদম (আঃ) থেকে ইব্রাহিম (আঃ) পর্যন্ত নবুয়তের প্রথম পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পরে, হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর মাধ্যমে নবুয়তের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। আল্লাহ তায়লা তার বান্দা ইব্রাহিম (আঃ) এর মাধ্যমে মক্কায় তাওহীদের মারকাজ পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার সন্তানদের মধ্য থেকে হযরত ইসমাইল (আঃ)-কে মক্কা ভূমিতে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নবুয়তের তৃতীয় এবং সর্বশেষ পর্ব রাসুল (স) এর মাধ্যমে শুরু হয় এবং তিনি সর্বশেষ নবী ও রাসূল। রাসুল (স) হযরত ইসমাইল (আঃ) এর বংশধর ছিলেন এবং তিনি যে দ্বীন-ইসলাম প্রচার করেছিলেন তার সাথে পূর্ববর্তী নবীদের দ্বীনের কোন পার্থক্য ছিলোনা।
সকল নবীদের বিশেষ করে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর প্রচারিত যে, দ্বীন তার ঐতিহ্যকে রাসুল (স) পুনরুজ্জীবিত করেছেন, প্রয়োজন অনুযায়ী সংযোজন ও বিয়োজন করেছেন। আর এই ধারাবাহিক আমলকে সাধারণ অর্থে সুন্নাহ বলা হয়।
যেমন হজ্বঃ হজ্ব মূলত হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সময় থেকে শুরু হয়েছে। মক্কার মানুষজন তা পালন করে এসেছিলো। রাসুল (স) এসে প্রয়োজন অনুযায়ী হজ্বের মধ্যে প্রচলিত জাহিলি কোনো বেদাতকে সংশোধন করেছেন এবং তা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ঠিক তেমনিভাবে রোজা , যাকাত , নামাজ ইত্যাদি এ সমস্ত আমল গুলো পূর্ববর্তী নবীদের মাধ্যমে চলে এসেছে। আর এগুলোকেই সুন্নাহ বলা হয়।
সুন্নাতের আমল নতুন কোন বিষয় নয়। যেমনটি কুরআনে আল্লাহ বলেছেন যে, রাসুল (স) নতুন কোন ধর্মাদর্শন নিয়ে আসেনি। তিনি ওই দ্বীন-ইসলাম নিয়ে এসেছেন যা এর পূর্বে নুহু , ইব্রাহিম , মুসা ও ইসা (আঃ)কে দেওয়া হয়েছিলো।
দ্বীন-ইসলামের এই অভিন্ন আমলকে সুন্নাহ বলা হয়। এর জন্যই পবিত্র কুরআনে নামাজ , রোজা , হজ্ব ইত্যাদি এ সকল আমল গুলোর ব্যবহারিক পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। তৎকালীন মক্কাবাসী এ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। রাসুল (স) এসে তাদের ঈমান থেকে শিরক ও আমল থেকে বেদাত সংশোধন করেছেন। তিনি তাওহীদকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। মিল্লাতে ইব্রাহীমের আদর্শকে বাস্তবায়ন করেছেন।
সুন্নাতের এই ঐতিহ্যকে রাসুল (স) তার উম্মতের মধ্যে আমলি ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন যেভাবে পবিত্র কুরআনকে হেফাজত করা হয়েছিলো। কুরআনের মত সুন্নতের আমল ইজমা ও তাওয়াতুরের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় মুসলিমদের মধ্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে।
শেষবারের মতো রাসুল (স) এর ইসলাম নিয়ে আগমনের পর থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে এমন কোন দিন আসেনি যেদিন মুসলিম বিশ্বে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সংঘটিত হয়নি। এমন কোন বছর আসেনি যে বছর মুসলিম বিশ্বে হজ্ব ও রোজা পালন করা হয়নি। সুতরাং সুন্নাতের বিষয়ে এ কথা স্পষ্ট যে সুন্নাহ সকল নবীদের যুগে এক ও অভিন্ন ছিলো। রাসুল (স) এর মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যে সুন্নাতের আমলগুলো প্রতিষ্ঠিত রয়েছে তা পবিত্র কুরআনের মত সম্পূর্ণ অবিকৃত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত।
হাদিস
রাসুল (স) স্রেফ ইসলামের বর্ণনাকারী ছিলেন না। তিনি ইসলামের সব থেকে বড় আলেম ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী বর্তমান সময়ে যদি কোনো শিক্ষার্থীর কুরআন বুঝতে সমস্যা হয় তাহলে অবশ্যই সে শিক্ষকের নিকট সহযোগিতা চাইবে। তিনি তার শিক্ষককে প্রশ্ন করবেন। রাসুল (স) এর সময় ইসলামের বিভিন্ন বিষয়-আশয় নিয়ে সাহাবাগণ তাকে প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি সে সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এছাড়াও রাসুল (স) কোনো কাজ করেছেন অথবা কাউকে কোনো কাজ করতে দেখে নিষেধ করেছেন বা উৎসাহ প্রদান করেছেন ইত্যাদি এ সমস্ত বিষয় মানুষজন দেখেছেন। পরবর্তীতে বিচ্ছিন্নভাবে এগুলো বর্ণনা করেছেন। এসকল বিষয়কে হাদীস বলা হয়।এ হাদীস গুলো রাসুল (স) এর জীবনী ইতিহাস। আমরা এর মাধ্যমে জানতে পারি রাসুল (স) দ্বীন-ইসলাম কিভাবে আমল করেছেন। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেমন ছিলো। ঠিক তেমনি ভাবে এ হাদিস গুলোর মধ্যে তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন বিষয় বর্ণিত হয়েছে। হাদিস মূলত ঐতিহাসিক বর্ণনা। আমাদের নিকট এই ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলোর অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। বলাবাহুল্য আমরা এই হাদীসগুলোকে বর্জন করতে পারিনা। যদি আমরা এগুলোকে বর্জন করি তাহলে ইসলামিক জ্ঞান শাখার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় থেকে বিমুখ হয়ে যাবো । ঠিক তেমনি ভাবে হাদীস গুলোকে আমাদের মূলনীতির আলোকে গ্রহণ করতে হবে।
উসওয়ায়ে হাসানা
উসওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে নমুনা বা উদাহরণ। সাধারণভাবে আমরা এটিকে ideal (আদর্শ) বলতে পারি।
পবিত্র কুরআনে উসওয়া শব্দটি একটি প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়েছে। সেটি হলো আহযাবের যুদ্ধের সময় যখন মুসলিমগণ সাহস হারিয়ে ফেলছিলেন তখন আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন “ ধৈর্য ও সংকল্পে রাসুল (স) হলেন তোমাদের জন্য সর্বোত্তম নমুনা বা আদর্শ।
সুতরাং এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি উসওয়ায়ে হাসানা মানে হচ্ছে দ্বীন-ইসলামের আমলের ক্ষেত্রে সবথেকে উত্তম যে নমুনাটি আমাদের নিকট প্রকাশিত হয় তা রাসুল (স) এর আদর্শ। তিনি কিভাবে উত্তম আমলের মাধ্যমে দ্বীন-ইসলামকে পালন করেছিলেন তা আমাদের জন্য উসওয়ায়ে হাসানা ।
সুন্নাহ , হাদিস ও উসওয়ায়ে হাসানার মধ্যে পার্থক্য
১- আমরা জেনেছি যে সুন্নাহ হলো দ্বীন-ইসলামের ওই আমল যা পূর্ববর্তী সকল নবীদের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন ভাবে চলে এসেছে। পরবর্তীতে রাসুল (স) এগুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন ও সংযোজন- বিয়োজন করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। মুসলিমগণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় ইজমা ও তাওয়াতুরের মাধ্যমে এই সুন্নাতের আমল সুপ্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। এগুলোকে সুন্নাহ বলা হয়।
২- হাদিস হলো ঐতিহাসিক বর্ণনা। রাসূল তার জীবদ্দশায় যা করেছেন এবং যা বলেছেন। মানুষজন তা শুনেছেন ও দেখেছেন এবং পরবর্তীতে নিজেদের মতো করে বর্ণনা করেছেন। এগুলোকেই হাদিস বলা হয়। উপরে উল্লেখিত সুন্নাতের সংজ্ঞার সাথে হাদিসের সংজ্ঞার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সুন্নাহ আমলের বিষয় আর হাদিস হলো ঐতিহাসিক বর্ণনা।
৩- উসওয়ায়ে হাসানা অর্থাৎ উত্তম নমুনা বা আদর্শ। রাসূল তার জীবদ্দশায় ইসলামের আমলগুলো কত উত্তম ভাবে পালন করেছেন তার নমুনা হচ্ছে উসওয়ায়ে হাসানা। সুন্নাহ ও হাদিসের সাথে উসওয়ায়ে হাসানার ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে । উসওয়ায়ে হাসানা মূলত আমলের সর্বোচ্চ উত্তম নমুনা।
সমাপ্ত
লেখকঃ মুহম্মদ সিয়াম হোসেন
এ প্রবন্ধটি উস্তাদ জাভেদ আহমদ গামিদি সাহেবের লেকচারের আলোকে সংকলন করা হয়েছে।