মরণোত্তর অঙ্গদান কি ইসলামে আসলেই নিষিদ্ধ?
বিগত দুই শতাব্দীতে বিজ্ঞান যে সব অসাধারণ চমক দেখিয়েছে এবং পুরো মানবজাতির জন্য যে সুযোগ-সুবিধা তৈরি করেছে তার মধ্যে একটি হল, অস্ত্রোপচার তথা সার্জারির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির অসুস্থ অঙ্গ অন্যজনের সুস্থ অঙ্গ দিয়ে প্রতিস্থাপন (ট্রান্সপ্ল্যান্ট) করতে পারা। এ কাজটা জীবিত অবস্থায় করা যায়, আবার (অঙ্গ দাতার) মৃত্যুর পরেও সম্ভব। এখন প্রশ্ন উঠে যে, কোনো ব্যক্তির পক্ষে কি তার জীবদ্দশায় তার কোনো একটি অঙ্গ অন্য কাউকে অসিয়ত করে যাওয়া ধর্ম ও শরীয়ত মোতাবেক জায়েয হবে কি না? কিংবা মৃত্যুর পর ওই অঙ্গ কেটে নিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তিকে দেয়া যাবে কি না? এই প্রশ্নের উত্তর হওয়া উচিত, হ্যাঁ, জায়েজ। কারণ আপাতদৃষ্টিতে কোরান ও হাদিসে এমন কোনো কিছু নেই যার মাধ্যমে এটিকে নিষেধ করা যায়। কিন্তু, আমাদের উপমহাদেশের আলেমগণ প্রায়শই এটিকে না জায়েজ বলে ঘোষণা করেন। এই বিষয়ে দুটি কথা পেশ করা হয়:
একটি হল যে, মানুষ তার নিজের শরীরের মালিক নয়। তাই, এটা তার অধিকারের মধ্যে পড়ে না যে, মৃত্যুর আগে সে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাউকে অসিয়ত করে যাবে। একজন মানুষের দেহ ঠিক ততক্ষণ তার নিজের অধিকারে থাকে, যতক্ষণ সে নিজে সেই দেহে বিদ্যমান থাকে। দেহত্যাগ করার পর সেই দেহের উপর তার কোনো অধিকার অবশিষ্ট থাকে না, যে অধিকারবলে সে তা উইল করে যেতে পারে এবং তার উইল কার্যকর ঘোষণা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মানুষের লাশের পবিত্রতা বজায় রাখা আবশ্যক। জীবিত কেউ তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বরং তার জন্য এটা ফরয যে, মরহুমের লাশ যথাযথ সম্মানের সাথে দাফন কবরে। একটি মানুষের লাশকে কাটা-ছেঁড়া করা বা তার কোনো অঙ্গ কেটে নেয়া মানে হচ্ছে সেই লাশের সম্মান নষ্ট করা। পৃথিবীর কোনো নৈতিক ব্যবস্থাই এটার অনুমোদন দিতে পারে না।
আমাদের মতে তাদের এই যুক্তিগুলো খন্ডনযোগ্য।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই যে সব কিছুর আসল মালিক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, একইভাবে একথাও সত্য যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে যে সব জিনিস দান করেছেন, ঐশী-সীমার মধ্যে থেকে, সে যে কোনো উপায়ে তা দান করার অধিকার মানুষ রাখে। এ কারণে, সে তার ইজ্জত, আব্রু, পরিবার-পরিজন এবং নিজ দেশ ও ধর্মের জন্য তার জীবন কোরবান করে দেয়। সে তার সম্পদ বিলিয়ে দেয়। নিজে নিহত হবে বা অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যাবে জেনেও সে এই উদ্দেশ্যে তার জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আগুনে ঝাঁপ দেয়, বড়-বড় বিপদের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। পবিত্র কোরআন মানুষের এই আত্মত্যাগকে জান ও মালের জিহাদ এবং আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং বিশ্বাসীদেরকে এইসব উদ্দেশ্যে দান করার জন্য জায়গায়-জায়গায় জোর প্রদান করেছে। এ থেকে স্পষ্ট যে কুরআন এই আত্মত্যাগের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়।
মানুষের ওসিয়ত বা উইল করার অধিকার এই আত্মত্যাগের অধিকারের একটি জরুরী অংশ। সুতরাং, মৃত্যুর পর আমাদের ধন সম্পদ উইল করে যাবার অধিকার যেমন আমাদের রয়েছে, তেমনি আমাদের লাশের জানাজা ও দাফন সম্পর্কেও ওসিয়ত করে যাবার অধিকার রয়েছে। সুতরাং নিজের অঙ্গ কাউকে দান করে যাবার অসিয়তও একই ধরনের কাজ। আগের সবগুলো একজন মানুষের মৃত্যু ও অঙ্গহানী হওয়া সত্ত্বেও যদি জায়েয হয়, তাহলে একজন ব্যক্তি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংক্রান্ত অসিয়ত করা কিভাবে বাতিল গণ্য হতে পারে?
লাশকে অপবিত্র করার বিষয়টিও একইভাবে দেখা উচিত। এটা নিয়ত ও আচরণের সাথে সম্পর্কিত। কোনো ব্যক্তির শরীরের ক্ষতি করা অপরাধ। কুরআনে এর জন্য কিসাস ও দেয়াতের হুকুম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ডাক্তার যখন রোগীর অনুমতি নিয়ে তার হাত বা পা কেটে ফেলে, তখন তাকে কেউই অপরাধী মনে করে না। তাহলে, মৃত ব্যক্তির শরীরের উপর ঘোড়া চালানো বা বিকৃতি ঘটানো, আর গবেষণা ও রোগ নির্ণয়ের জন্য লাশের ময়নাতদন্ত করার মধ্যে পার্থক্য কেন করা হবে না ? যদি কোনো ব্যক্তি তার সম্পদ অভাবগ্রস্ত কাউকে দেবার অসিয়ত করে যান, এটি একটি নেক কাজ। একইভাবে, যদি সে তার কোনো অঙ্গ চাহিদাগ্রস্থ কাউকে দেবার অসিয়ত করে সেটিকেও একটি নেক কাজ বলা উচিত। কেনো এই অসিয়ত সম্পন্ন করাকে মৃতদেহের অপবিত্রতা হিসেবে গণ্য করা হবে?
উস্তাদ জাভেদ আহমেদ গামিদির লেখা অবলম্বনে রচিত
অনুবাদঃ মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন