পবিত্র কুরআনের একক ব্যাখ্যা [১]
মূল লেখক ইমাম হামিদ উদদিন ফারাহি (রহ)
পবিত্র কুরআনুল কারীম মানবজাতির জন্য প্রেরিত হেদায়েত গ্রন্থ। এর প্রত্যেকটি আয়াত একটি সুনির্দিষ্ট ও একক বার্তা দিয়ে থাকে। যদিও মুফাসসিরগণ কুরআনের একটি আয়াতের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। তবে তারা কখনই এটা বলেননি যে একটি আয়াতের অসংখ্য ব্যাখ্যা রয়েছে। তারা কেবল আমাদের পূর্ববর্তী মনীষীদের নিকট থেকে প্রাপ্ত ব্যাখ্যাগুলোকে যাচাই-বাছাই এর মাধ্যমে একত্রিত করে গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন এবং সেই ব্যাখ্যাসমুহ থেকে সঠিক ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করার এখতিয়ার আমাদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন ।
সুতরাং, কুরআনের এই সকল ব্যাখ্যাগুলোকে যাচাই-বাছাই ছাড়া অন্ধভাবে গ্রহণ করে অজ্ঞতা ও সন্দেহের গোলকধাঁধায় বিচরণ করা আমাদের জন্য একদমই উচিত নয়।
ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (রহ) সূরা বাকারার ১৯১ আয়াতের ব্যাখ্যায় “ফিতনাহ” শব্দটির [২] পাঁচটি অর্থ দেখিয়েছেন এবং যথাযথ গবেষণার পরে যা সঠিক মনে করেছেন তা উল্লেখ করেছেন। অতীতের বড় বড় আলেমগণ সর্বদা এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। কুরআনের এই বাহারি ব্যাখ্যা একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠককে সন্দিহান করে যে আসলে কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল। কখনো কখনো এমন হয় যে পাঠক এসকল ব্যাখ্যাগুলোকে যাচাই-বাছাই না করে গ্রহণ করা শুরু করে দেয়। আমার দৃষ্টিতে এই ধরনের কর্মকাণ্ড নেহায়েৎ অন্যায় কাজ। আমি পূর্ববর্তী মুফাসসিরগণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করিনি। বরং আয়াতগুলোকে পবিত্র কুরআনের সমান্তরালে রেখে প্রেক্ষাপটের আলোকে চিন্তাভাবনা করেছি।
আমার নিকট যখন আয়াতের মূলভাব স্পষ্ট হয়েছে তখন আমার উপলব্ধির সমর্থনে বিখ্যাত মুফাসসিরগণ, যেমন ইমাম তাবারী ও ইমাম রাজীর মত পূর্ববর্তী কুরআনের ব্যাখ্যামূলক রচনার সাথে তা মিলিয়ে দেখেছি। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাথে আমার উপলব্ধির পুরোপুরি মিল ছিল আবার কখনো কখনো তা কাছাকাছি ছিল। অনেক বিষয়ে কুরআনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আমার পূর্ববর্তী উপলব্ধি পরিত্যাগ করতে হয়েছে এবং কুরআনের অনেক আয়াতের ক্ষেত্রে আমার গবেষণা ও পর্যালোচনার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চালাতে হয়েছে। এ বিষয়টিকে আমি আমার জ্ঞান ও উপলব্ধির দুর্বলতা হিসেবে স্বীকার করি।
এটা শুনতে আপনাদের অবশ্য অবাক লাগতে পারে যে পবিত্র কুরআনের মতো স্পষ্ট গ্রন্থ অধ্যায়ন করেও মানুষ মাঝে মাঝে বিভ্রান্তির শিকার হতে পারে। কয়েক শতাব্দী ধরে চলা বুদ্ধিবৃত্তিক কলুষতার বহুস্তরীয় উদাসীনতা এর জন্য দায়ী। কেউ যদি বুদ্ধিবৃত্তিক অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে তবে তার নিকট অনেক স্পষ্ট তথ্য সন্দেহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
আল্লাহর অস্তিত্ব, তাওহিদ, সকল কিছুর উপর তার কর্তৃত্ব এবং বিচার দিবসের সত্যতা, ইত্যাদি বিষয়, যা একজন যুক্তিবাদী ও বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষে কখনোই অস্বীকার বা সন্দেহ করার অবকাশ নেই, তারপরেও অনেকে সন্দেহ করে, এমনকি স্রষ্টার অস্তিত্ব পর্যন্ত অস্বীকার করে!
সত্য কথা হল শরীরের মত আত্মারও কিছু ব্যাধি রয়েছে।
একবার এই ব্যাধিতে কেউ আক্রান্ত হলে সুস্পষ্ট তথ্যগুলি তার নিকট ঝাপসা হয়ে যায়। একটি অসুস্থ মন কখনোই সত্য উপলব্ধি করতে পারে না।
সূর্যালোকের উত্তাপে ঘেমে যাওয়া একজন সুস্থ মানুষের অভিজ্ঞতা কি কখনো অন্ধ, অসুস্থ, প্রচন্ড জ্বরে ভোগা কেউ উপলব্ধি করতে পারে ?
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ৷ তাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সত্যকে গ্রহণ করা বা সত্য পথে চলা সবার জন্য সম্ভব নয়। কুরআন থেকে হেদায়েত কারা নিতে পারবে তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন
هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ
অর্থঃ (এই কুরআন) মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত গ্রন্থ।
(সূরা বাকারা আয়াত ২)
এ সম্পর্কে আল্লাহ আরো বলেন
إِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ جَعَلْنَا بَيْنَكَ وَبَيْنَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ حِجَابًا مَّسْتُورًا
যখন আপনি কোরআন পাঠ করেন, তখন আমি আপনার মধ্যে ও পরকালে অবিশ্বাসীদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন পর্দা ফেলে দেই। (সূরা বনী ইসরাঈল আয়াত ৪৫)
দার্শনিক সক্রেটিসের একটি মন্তব্য এমন যে, তিনি বলেন
”Human soul knows everything but at times forgetfulness overtakes”
অর্থাৎ মানুষের আত্মা সবকিছু জানে কিন্তু মাঝে মাঝে বিস্মৃতি তাকে আক্রান্ত করে ।
মাওলানা রুমি (রহ) বলেন,
“Do not interpret the Qur’ān according to your personal desire, rather accord yourself with what the Holy Qur’ān says”.
অর্থাৎ নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কুরআনের তাফসির করো না, বরং পবিত্র কুরআন যা বলেছে তার সাথে নিজেকে মানিয়ে নাও।
আল্লামা হাফিজ (রহ) বলেন
The greatest veil is your nafs (self); remove it
অর্থাৎ সবথেকে বড় আবরণ তোমার নফস তাই তা মুছে ফেলো ।
সারাংশঃ
আমি মনে করি যে পবিত্র কুরআন তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট এবং উপযুক্ত শৈলীতে প্রকাশ করেছে। কুরআনের কোন বক্তব্য যদি প্রথাগত বিষয় থেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয় তাহলে বুঝে নিতে হবে তা নির্দিষ্ট কোন দিকে ইঙ্গিত করার জন্য করা হয়েছে। আমি এই বইটির একটি পৃথক ভূমিকায় এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব এবং সেখানে এই নীতিগুলিকে বিশদভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করব যা একটি কুরাআনের আয়াতের একাধিক ব্যাখ্যার সম্ভাবনাকে দূর করে। [৩]
আমি এই বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত যে মুতাশাবিহ (রূপক) আয়াত এবং হুরুফুল মুকাত্তা’আত (বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমুহ) আয়াতগুলো কোন অস্পষ্ট বিষয় নয়। পরবর্তীতে এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
তথ্যসূত্র
১-প্রবন্ধটির মূল লেখা Farāhī’s Majmū‘ah থেকে নেয়া হয়েছে।
২ -উল্লেখিত আয়াতে বলা হয়েছে: ফিতনা হত্যার চেয়েও জঘন্য। (2:191)। ইমাম রাজী আয়াতটিতে ফিতনা শব্দের নিম্নোক্ত পাঁচটি ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন: (i) আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস, (ii) পরীক্ষা ও পরীক্ষায় নিয়োজিত যা কিছু, (iii) অবিশ্বাসের কারণে অবিশ্বাসীদের জন্য চিরস্থায়ী শাস্তি, (iv) কাফেরদের দ্বারা মুসলমানদের বশ্যতা, তাদের ঈশ্বরের ঘরে যাওয়ার অধিকার অস্বীকার করা এবং (v) ইরতিদাদ (ধর্মত্যাগ)। (রাজি, আল-তাফসীর আল-কবীর, ৪র্থ সংস্করণ, খণ্ড 5 (মাকতাব আল-আলাম আল-ইসলামী, 1313 হিজরি), 142-3)
৩-ইমাম হামিদ উদ্দিন ফারাহি (রহ) তার একটি অপ্রকাশিত রচনায় ব্যাখ্যার নীতিগুলি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এই রচনাটি দীর্ঘকাল ধরে প্রকাশিত হয়েছে:
আত-তাকমিল ফি উসুল আত-তাউইল, (‘আজমগড়, ভারত: আদ-দাইরাহ আল-হামিদিয়া ওয়া মাকাতাবাতুহু, ১৩৩৮/১৯৬৮) ( ইংরেজি অনুবাদক তারিক মুহাম্মদ হাসিম)
অনুবাদঃ ইবনে আনিস ইবনে ইসমাইল
সম্পাদনাঃ মঞ্জুর এলাহী