কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়েত হলে এটি বোঝা এত কঠিন কেনো?
এটি একজন মুসলিমের অন্তরে তৈরি হওয়া সাধারন প্রশ্ন। পবিত্র কুরআন গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্য হেদায়েত, এটি সর্বজনীন আসমানী গ্রন্থ। এ কারণে এই মহাগ্রন্থের বিধি-বিধান শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের নিকট বোধগম্য হওয়া জরুরী, কুরআনের দাবীও তাই।
কিন্তু প্রায় সময়ই আমরা কুরআনের উচ্চ স্তরের আলেম বা গবেষকবৃন্দকে বলতে শুনি যে, কুরআনে গবেষণা, এর অন্তর্নিহিত ভাব-গম্ভীর্যতা উপলব্ধি, এর বক্তৃতাশৈলী, পারস্পরিক যোগসূত্র (নাযমে-কালাম), উচ্চস্তরের প্রাচীন আরবি ভাষার মাধুর্যতা ইত্যাদি বোঝা কঠিন, নিরলস পরিশ্রমের কাজ। এর জন্য সময় এবং মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হয়। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন চলে আসে যে কুরআন একটি সর্বজনীন গ্রন্থ হওয়া সত্বেও এটি অধ্যয়ন করা এত কঠিন কেনো?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো পবিত্র কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে, তাই আরবি ভাষাভাষীদের জন্য এটি বোঝা সহজ। কিন্তু যারা আরবি ভাষা সম্পর্কে অবগত নয়, এমনকি যাদের ভাষা পরিবার (language family) আরবি ভাষা পরিবারের সাথে কোনো প্রকার সম্বন্ধ রাখে না, সেই সকল মানুষ কুরআন কিভাবে অধ্যয়ন করবে? কুরআনের বার্তা কিভাবে বুঝবে? সর্বজনীন গ্রন্থ হিসেবে কুরআন নির্দিষ্ট একটি ভাষায় নাযিল হওয়া কতটা যৌক্তিক? সর্বোপরি যদি কুরআন বোঝা কঠিন হয়ে থাকে তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতি কিভাবে এর মধ্য থেকে হেদায়েত সংগ্রহ করবে?
উপরের প্রশ্ন দুটিকে আমরা তিনটি অংশে বিভক্ত করে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব।
প্রথমাংশ: কুরআন প্রাচীন আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে। এর অভ্যন্তরীণ ভাব-গম্ভীর্যতা, যোগসূত্র ইত্যাদি বিষয়গুলো একজন সাধারন মানুষের পক্ষে উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। তাহলে একজন সাধারন মুসলিম কিভাবে কুরআন অধ্যয়ন করবে?
এর সহজ উত্তর: পবিত্র কুরআনের উচ্চ স্তরের গবেষণা সাধারণ মুসলিমের কাজ নয়। কথাটি শুনতে আপনাদের অন্যরকম মনে হলেও এটিই সত্যি যে, কুরআন গবেষণা সাধারণ মানুষের কাজ নয়। যদি কেউ কুরআন গবেষণা করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই এই কঠিন পথ অতিক্রম করে একজন গবেষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
এটি শুধু কুরআনের ক্ষেত্রে নয়, পৃথিবী সকল জ্ঞান শাখার ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। উদাহরণস্বরূপ বাংলা ভাষার কথাই চিন্তা করুন, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। সাধারণভাবে আমাদের ভাব প্রকাশের জন্য বাংলা ভাষার যতটুকু জ্ঞান প্রয়োজন আমাদের তা এমনিতেই রয়েছে। কিন্তু কেউ যদি বাংলা ভাষার উচ্চ স্তরের গবেষক হতে চায়, অথবা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য অধ্যয়ন করতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে গবেষক হওয়ার এই কঠিন পথ অতিক্রম করতে হবে। আর গবেষক হওয়ার কাজ সকল বাঙালীদের উপর বাধ্যতামূলকও নয়।
চর্যাপদের একটি কবিতার লাইন:
“রুখের তেন্তুলি কুম্ভীরে খাঅ” অর্থাৎ: গাছের তেঁতুল কুমিরে খায় এই বাক্যের ভাব উপলব্ধি করার কাজ বাংলা ভাষা বিজ্ঞানীদের, সাধারণ বাঙালিদের নয়।
তবে বাঙালি হিসেবে সচারচর ব্যবহৃত বাংলা ভাষার শব্দ সম্পর্কে অবগত হওয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু ভাষার গবেষক হওয়া অবশ্যই কঠিন, হোক তা অন্য ভাষা বা নিজ মাতৃভাষা এবং এই কঠিন কাজটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তাই পবিত্র কুরআনের গবেষণা, এর উচ্চ স্তরের ভাব-গম্ভীর্যতা উপলব্ধি করা, এর অন্তর্নিহিত যোগসূত্র বোঝা আমাদের আলেমদের কাজ। আর এই কাজ শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের আলেমগণ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকবে।
দ্বিতীয়াংশ: সর্বজনীন গ্রন্থ হিসেবে কুরআন নির্দিষ্ট একটি ভাষায় নাযিল হওয়া কতটা যৌক্তিক? এর উত্তর হবে, পবিত্র কুরআন যার উপর নাযিল হয়েছে এবং তিনি যে জাতিকে উদ্দেশ্য করে প্রথমে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন সবার আগে এই কুরআনের বার্তা তাদের বোঝা জরুরী ছিলো। রাসুল (স) তার জাতির উপর ইতমামুল হুজ্জাত (সত্যের চূড়ান্ত প্রমাণ) সংগঠিত করতে এসেছেন। প্রত্যেক রাসুল তার জাতির নিকট আল্লাহ তায়ালার আদালত হিসেবে উপস্থিত হন এবং সত্যের প্রমাণ পরিপূর্ণভাবে পেশ করে থাকেন।
তাই এটি জরুরী যে রাসুল (স) এর মাতৃভাষা যেটি ছিলো এবং তিনি যে জাতির উপর হুজ্জাত সংগঠিত করেছেন সেই ভাষাতেই কুরআন নাযিল হবে। পৃথিবীর সমস্ত নবী-রাসূলদের নিকট তাদের মাতৃভাষায় আল্লাহ তায়ালা ওহী প্রেরণ করেছেন। তাই কুরআন যদি অন্য একটি ভাষায় নাযিল হতো তাহলে না এটি যার উপরে নাযিল হয়েছে তিনি উপলব্ধি করতে পারতেন, আর না যাদের উদ্দেশ্য করে তিনি ইনযার (সতর্ক) করেছেন তারা এর বার্তা বুঝতে পারতো। এজন্যেই কুরআনে বলা হয়েছে যে এই গ্রন্থ স্পষ্ট আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে, ওই আরবি ভাষায় যে ভাষায় রাসুল (স) কথা বলতেন।
শেষাংশ: পবিত্র কুরআনের বার্তা কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ কিভাবে বুঝবে? এ প্রশ্নটির উত্তর আরো সহজ। সার্বজনীন ভাবে দ্বীন-ইসলামের বিধি-বিধান বোঝা এবং তা মান্য করার জন্য কুরআন অধ্যয়ন খুবই সহজ। এতটাই সহজ যে, এর জন্য আরবি ভাষা শিক্ষারও কোনো প্রয়োজন নেই। কেউ যদি ইসলামী বিধি-বিধান পালন করার জন্য পবিত্র কুরআনের সরল অনুবাদ পড়ে তাহলে সে খুব সহজেই তা বুঝতে পারবে। কুরআনের বার্তা বোঝার জন্য উচ্চস্তরের গবেষণার কোনো প্রয়োজন নেই, সামান্য প্রচেষ্টাই যথেষ্ট।
কেউ যদি চায় ছয় মাস বা এক বছরের কুরআনিক অ্যারাবিক কোর্স করার মাধ্যমে কুরআনের আরবি ভাষাও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। অন্য ভাষাভাষীদের কুরআনের বার্তা বুঝতে অসুবিধা হবে এমন কোনো বিষয় নেই। আল্লাহ আমাদেরকে মেধাশক্তি দিয়েছেন, আমরা এই মেধাশক্তিকে সামান্য ব্যবহার করলেই কুরআনের বার্তা অনুধাবন করতে পারব, এর মধ্য থেকে নিজের জীবন চলার পথের হেদায়েত সংগ্রহ করতে পারব।
কুরআনের বার্তা বোঝা আর উচ্চ স্তরের গবেষণা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
একজন সাধারন মুসলিম নিজের জীবনে ইসলামের শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সহজভাবে কুরআন পড়া এবং তা মান্য করাই হলো কুরআনের বার্তা উপলব্ধি এবং এটি অত্যন্ত সহজ। আর গবেষনা হলো কুরআনের উসুলের প্রয়োজনীয়তা বোঝা, উসুলের ভিন্নতা কেনো রয়েছে তা জানা, আরবি প্রাচীন সাহিত্যের উচ্চস্তরের জ্ঞান অর্জন করা। এগুলো যদি কেউ করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই গবেষণার কঠিন পথ অতিক্রম করতে হবে। আর যদি কোনো ব্যক্তি মনে করে যে, এত কঠিন পথ অতিক্রম করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে গবেষণা কাজে তার হাত না দেয়াই সমীচীন।
(লেখাটির মূল তথ্য পাকিস্তানি ইসলামী চিন্তাবিদ এবং হাদিস গবেষক জনাব মোহাম্মদ হাসান ইলিয়াস সাহেবের লেকচার থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)
লেখক: ইবনে আনিস ইবনে ইসমাইল
সম্পাদনা: উস্তাদ মনজুর এলাহী