ইসলামে কুকুর পালন প্রসঙ্গে
উস্তাদ জাভেদ আহমদ গামিদি সাহেবের প্রশ্ন উত্তর পর্ব
কুকুর পালন করা কি ইসলামে হারাম? কুকুর ঘরে থাকলে নাকি সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করেনা? কুকুর কোনো খাবারে মুখ দিলে নাকি সেটা অপবিত্র হয়ে যায়? তেমনি কুকুর গায়ে লাগলে সেই জামা নাকি অপবিত্র হয়? এব্যাপারে সঠিক উত্তর জানতে চাই।
আসসালামু আলাইকুম, বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
কুকুর পালন করাকে ইসলামে নিষেধ করা হয়নি। মানুষ কুরআন মাজিদ একদমই বুঝে পড়েনা। তাই এব্যাপারে জানেনা। সূরা মায়েদায় আল্লাহ্ বলেছেন তোমরা যে কুকুরদের শিকারের প্রশিক্ষণ দাও সেই জ্ঞান আমি তোমাদের দিয়েছি। আর তোমরা শিকারি কুকুরদেরকে আল্লাহ্র নাম নিয়ে শিকারে পাঠালে এবং তারা কোনো প্রাণী শিকার করে আনলে সেটা জবেহ করা ছাড়াই তোমাদের জন্য হালাল হবে।
তারমানে ”বিসমিল্লাহ” বলে যদি কেউ তার কুকুরকে শিকারে পাঠায় আর সেই কুকুর যদি কামড়ে একটা প্রাণী শিকার করে আনে সেটা জবেহ করা ছাড়াই আমাদের জন্য খাওয়া হালাল হবে। এবার বলুন কুকুর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তো তাকে পালতে হবে, তানাহলে কি আকাশ থেকে আপনাকে কেউ প্রশিক্ষণ দেওয়া কুকুর পাঠাবে? আর শিকারি কুকুর কিন্তু মুখ দিয়েই শিকার কামড়ে নিয়ে আসবে। তাই যেমনটা বলা হয় অপবিত্রতার ব্যাপারে সেটাও ঠিক নয়।
.
কুরআনে অনেক প্রসিদ্ধ একটি অলৌকিক ঘটনা আল্লাহ্ আমাদের জানিয়েছেন আসহাবে কাহফ এর ব্যাপারে। আপনারা জানেন আল্লাহ্ কিভাবে সেটা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ বলেন, “তুমি মনে করবে যে তারা সজাগ, অথচ তারা ছিল ঘুমন্ত, আমি তাদের ডানে বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম। আর তাদের কুকুরটি ছিল গুহাদ্বারের সম্মুখে তার সামনের পা দু’টি প্রসারিত করে।” (কাহফ ১৮) … সুতরাং কুকুরের ব্যাপারে দয়া করে খারাপ ধারনা পোষণ করা বন্ধ করুন। আল্লাহ্ বরং কুকুরের প্রশংসা করেছেন। কুকুরের আরবি হচ্ছে كلاب (কালব) , কিন্তু আল্লাহ্ সূরা মায়েদার আয়াতে مُکَلِّبِیۡنَ (মুকাল্লেবিন) শব্দ ব্যাবহার করেছেন।
.
অনেকে শিকারি কুকুর পালন বৈধ বলে আর বাসা বাড়িতে কুকুর পালনকে হারাম বলে। এটা আরেকটি ভুল ধারনা। তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে আপনার কুকুরকে একটু পাহাড়া দিতে বলবেন তাহলেই হবে। যাতে যায়েজ হয়ে যায়। দ্বীনের ব্যাপারে কোনো হুকুম দিতে হলে সেটার ভিত্তি শক্তিশালি হতে হবে। কুরআন মাজিদ কুকুরের ব্যাপারে কত সুন্দরভাবে প্রশংসা করে আয়াত নাজিল করেছেন।
.
এমনকি আরবে প্রায় সবাই কুকুর পালন করতো। ছাগল ভেড়ার রক্ষণাবেক্ষণ যারা করতো তাদের জন্য কুকুর ছাড়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যেতো। আর যেই কুকুর আপনি কাজে লাগাবেন সেটা স্বাভাবিকভাবেই আপনাকে লালন পালন করতে হবে। সেই পালিত কুকুরকে আপনি আদর করবেন, ভালবাসবেন, গোসল করাবেন, খাবার খাওয়াবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই কুকুর নাপাক বা গায় লাগলে অজু চলে যাবে এমন কিছু ভাবাটা ভুল।
.
একটি হাদিস ভুলভাবে বুঝার কারনে ভুল বুঝাবুঝির তৈরি হয়েছে। হাদিসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বর্ণনাকারী ঐ হাদিসের প্রেক্ষাপট, সময়, কারন, আর কাকে কি উদ্দেশ্যে কথাটি বলা হয়েছিলো এগুলা সহ বর্ণনা করেনা। আর একারনে আলেমরাও শুধু হাদিসের মূল কথাটি শুনে ফতোয়া দিয়ে ফেলে।
.
ইসলাম ধর্মে একটি ‘জীবন’কে অনেক বড় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সেটা মানুষের হোক বা প্রাণীর হোক। তাই আল্লাহ্ বলেছেন নিরপরাধ একজন মানুষ হত্যা করা মানে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করার মত অপরাধ। ঠিক তেমনি বিনা প্রয়োজনে কোনো প্রানিকে হত্যা করা বা বেঁধে রাখাও হারাম করা হয়েছে। রাসুল (সঃ) বলেছেন এক মহিলা বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিলো তারপর বিড়ালটি মারা যায় তাই সে জাহান্নামে যাবে।
আপনার প্রয়োজনে আপনি যদি কোনো প্রাণীর গোশত খেতে চান তাহলে সৃষ্টিকর্তা কিছু শর্ত দিয়েছেন সেটা মেনে তাকে জবেহ করা যাবে। তা হচ্ছে আল্লাহ্র নাম নিয়ে পশুটি জবেহ করতে হবে এবং তার রক্ত প্রবাহিত করতে হবে। এই দুইটা শর্ত মেনে কোনো পশুকে জবেহ করা যাবে। কিন্তু সেটা গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে। তেমনি ক্ষতিকর কোনো প্রাণীকেও ক্ষতির আশঙ্কায় হত্যা করা যাবে। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে শুধু শুধু একটি পিঁপড়াও হত্যা করা হারাম। সুতরাং কোনো কারন ছাড়া কোনো কুকুর বা প্রাণী বেঁধে বা আটকে রাখা যাবে না।
.
প্রথমে এটা ঠিক করুন আপনি কি উদ্দেশ্যে প্রাণীটাকে পালন করতে চান? সেটা যেন কোনো পশুকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য না হয়। পশু পালনের ক্ষেত্রে তাকে পোষ মানানোর জন্য কয়েকদিন আটকে রাখতে হবে এটা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয় খাবার ও সকল প্রকারের প্রয়োজন আপনাকে মেটাতে হবে।
.
মদিনায় বাচ্চারা কুকুরকে শুধু-শুধু বেঁধে রাখতো আর এভাবে কষ্ট দিতো। শহরেও দেখতে পাবেন অনেক দুষ্টু ছেলেরা কুকুরকে এভাবে বেঁধে বা ইট মেরে কষ্ট দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে রাসুল (সঃ) বলেছেন কুকুরকে বিনা প্রয়োজনে এভাবে বেঁধে রেখে কষ্ট দেওয়া যাবে না। এমনটা করা উচিৎ নয়। “কুকুরকে বেঁধে রাখা নিষেধ” এই কথাকে “কুকুর পালন করা নিষেধ” মনে করে নিয়েছে মানুষ।
.
মনে করুন আপনার ঘরে একজন মেহমান বেড়াতে আসলো। আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে প্রত্যেকের নিজের কিছু পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার থাকে। এভাবেই জিবরাঈল (আ) একদিন রাসুল (সঃ) এর কাছে এসেছিলেন আর ঐ অবস্থায় রসুলের (সঃ) খাটের নিচে একটি কুকুর ছিলো। তখন জিবরাঈল (আ) বললেন আপনার ঘরে কুকুর আছে তাই আমি প্রবেশ করবো না। যেই ঘরে কুকুর থাকে সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। ব্যস এইটুকুই ছিলো উনার বেক্তিগত একটি অপছন্দের বিষয়। স্বাভাবিকভাবেই রসুলের (সঃ) এর সাথে জিবরাঈল (আ) এর আসা যাওয়ার মত বিষয় তো আর আমাদের সাথে হবে না। ফেরেশদের ক্ষেত্রে তাদের অপছন্দের বিষয় এই হাদিসে প্রমানিত হয় এর বাইরে কিছুই না। এখানে আল্লাহ্ বা আল্লাহ্র রসূল (সঃ) কুকুরের ব্যাপারে এই নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন না।
.
রহমতের ফেরেশতা কিভাবে ঘরে আসে আর কিভাবে রহমত নাজিল করে সেটা তো আল্লাহ্ ভালো জানেন। যদি এক্ষেত্রে কুকুরের সাথে প্রাসঙ্গিক কোনো বিষয় থাকতো তাহলে আল্লাহ্ কুরআন মাজিদেই বলে দিতেন বা রাসুল (সঃ) কুকুর পালন হারাম বলে দিতেন। কিন্তু এমন কিছুই কুরআন হাদিসে নেই। বরং ফেরেশতা জিবরাঈল (আ) এই কথা বলেছেন সেটা হতে পারে উনার ব্যক্তিগত অপছন্দের বিষয়। ফেরেশতাদের নিজস্ব একটি সেনসিটিভ বিষয় থাকতেই পারে। শিকারি কুকুরও তো পালন করাই লাগে এর মানে তো এই না যে সেখানে রহমত প্রেরন করা বন্ধ হয়ে যায়। বরং আল্লাহ্ তাদের ব্যাপারে প্রশংসা করেছেন যেমনটা উপরে বললাম।
.
অপবিত্রতার ব্যাপারে দ্বীন কিছু বলা ছাড়াই স্বভাবগতভাবে আমরা সবাই জানি যে অপবিত্র কিছু আমাদের জামা কাপড়ে বা খাবারে লেগে গেলে সেটা পরিষ্কার করতে হয়। যেহেতু কুকুরের বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে আর সেটা মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে এবং বেওয়ারিশ কুকুর অপবিত্র জায়গায় হাটাচলা করে আর খায়, তাই রাসুল (সঃ) বলেছিলেন কুকুর কোনো খাবারে মুখ দিলে সেটা ভালোভাবে ধুয়ে নিও। এই হাদিসটিও ভুলভাবে মানুষ গ্রহন করেছে। এখানে অপবিত্রতার কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু মানুষ কুকুরকে অপবিত্র মনে করে আর বিড়ালকে পবিত্র মনে করে। অথচ বেওয়ারিশ বিড়া লগুলোও কিন্তু বিভিন্ন গলিতে, ড্রেনে, ময়লায় হেটে বেড়ায় আর তাতেও তদের পায়ে অপবিত্রতা লেগে যায়। সেই বিড়াল ঘরে প্রবেশ করলেও কিন্তু অপবিত্র হয়। তাই খেয়াল রাখতে হবে অপবিত্র আর নোংরা বিষয়গুলো থেকে যেন প্রানিকে পরিষ্কার পরিছন্ন রাখা হয়।
অনুবাদকঃ আরিফ আহমদ