ইসলামের দৃষ্টিতে কাফির কে?
ইসলামে কুফরের শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম।(১) কুফরের বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আমাদের বলা হয়েছে যে, এই শাস্তি তখনই দেয়া হবে যখন কোনো ব্যক্তি জেনে-বুঝে সত্যকে অস্বীকার করবে।(২) তবে কোনো ব্যক্তি সত্যকে জেনে-বুঝে অস্বীকার করেছে কীনা, সত্য তার নিকট পূর্ণাঙ্গভাবে পৌঁছেছে কিনা, সত্যকে অস্বীকারের ক্ষেত্রে তার জেদ, গোঁড়ামি বা কুসংস্কারই মূল কারণ ছিলো কিনা, এ বিষয়গুলো আমি আপনি অথবা দুনিয়ার কোনো আদালত নিশ্চিতভাবে জানতে পারব না।
তবে যে কাজটি আমরা করতে পারি তা হলো আমরা মানুষকে বলতে পারি যে কুফর কাকে বলে বা শির্ক আসলে কী? কুফর এবং শির্কের সংজ্ঞা আমরা মানুষকে জানাব, মানুষকে এটা থেকে বেঁচে থাকার দাওয়াত দিব। কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে কাফির ঘোষণা করার অধিকার আমাদের নেই। কাউকে কাফির বলার অধিকার একমাত্র আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের রয়েছে।(৩) আর রাসুলকে এ অধিকার এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে জানানো হয়ে থাকে এই লোকগুলো নিজেরদের জেদবশত সত্যকে বর্জন করেছে এবং তারা জেনে-বুঝে সত্যকে অস্বীকার করেছে।(৪)
অন্যান্য ধর্মের মানুষদের আমরা অমুসলিম বলে সম্বোধন করতে পারি। বর্তমান পৃথিবীতে যে সকল মানুষ মুসলিম নয় তারা হলো অমুসলিম। এই অমুসলিমদের মধ্যে অনেক মানুষ আছে যারা শির্ক অথবা কুফর করছে। আমাদের দায়িত্ব হলো তাদের নিকট কুফর এবং শির্কের সংজ্ঞা তুলে ধরা। কিন্তু তাদের কাফির ঘোষণা করার অধিকার আমাদের নেই। বরং আমরা তাদেরকে অমুসলিম বলেই সম্বোধন করব। এটি হলো প্রথম বিষয় এবং এটি আমাদের খুব ভালোভাবে স্মরণ রাখতে হবে।
দ্বিতীয় বিষয় হলো আল্লাহ অমুসলিমদের সাথে কী ফয়সালা করবেন? পবিত্র কুরআন আমাদের বলেছে যে আল্লাহ তায়ালার নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন বা ধর্ম হচ্ছে ইসলাম।(৫) এর অর্থ কী? এর অর্থ হলো কেউ এমন কথা বলতে পারবে না যে ইসলাম ভিন্ন অন্য যে সকল পথ রয়েছে সেগুলোও আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত হেদায়েত। এ কথা কেউ বলতে পারবে না যে সত্য পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য ইসলাম ভিন্ন অন্য আরো রাস্তা রয়েছে। কুরআন আমাদের স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে যে আল্লাহ তায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন কেবল একটি আর তা হলো ইসলাম। এই ইসলাম আল্লাহ তায়ালা তার সমস্ত নবী-রাসূলদের দিয়েছিলেন। সমস্ত নবী-রসূল এই একই দ্বীন-ইসলাম নিয়ে আগমন করেছেন।
আল্লাহ রাসুল (স)কে সম্মোধন করে সূরা আশ-শুরায় বলেছেন:
“তিনি তোমাদের জন্য ওই দ্বীনটাই নির্ধারণ করেছেন যেটির ব্যাপারে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর (হে নবী!) যেটি আমি আপনার প্রতি ওহি করেছি আর ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে আমি যেটির নির্দেশ দিয়েছি এ কথা বলে যে, (নিজেদের জীবনে) এই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখো আর তাতে ফাটল সৃষ্টি করো না।”
(সূরা আশ-শুরা:১৩)
এই একই কথা কুরআনে বেশ কয়েকবার এসেছে। এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা এ কথা স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারি যে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দুইটি ধর্ম দেননি। অর্থাৎ বিষয়টি এমন নয় যে, আল্লাহ তায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য ধর্ম ইসলাম ভিন্ন আরো অনেকগুলো রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ: খ্রিষ্ট মতবাদ, ইয়াহুদি মতবাদ, হিন্দু মতবাদ, বৌদ্ধ মতবাদ ইত্যাদি।
আপনারা জেনে থাকবেন যে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের দার্শনিকগণ বলে থাকেন মানবজাতির আসল কাজ হচ্ছে স্রষ্টার নিকট পৌঁছানো, স্রষ্টার মারেফত সম্পর্কে অবগত হওয়া, স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করা। এই সন্তুষ্টি অর্জন করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্ম হতে পারে, আর সব ধর্মই সঠিক হতে পারে। কিন্তু কুরআন এই দর্শনকে সমর্থন করেনা। কুরআন আমাদেরকে বলেছে যে আল্লাহর নিকট পৌছাবার রাস্তা একটাই যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী-রাসুলদের মাধ্যমে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। আর এই রাস্তার নাম হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম শব্দের অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা।
এখন প্রশ্ন হলো যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি বা মুসলিম নয় তাদের সাথে আল্লাহ কী ফয়সালা করবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে তাকে প্রদত্ত জ্ঞান অনুযায়ী ফায়সালা করবেন।(৬) এটা সত্য যে সকল মানুষের কর্তব্য তারা আল্লাহ প্রদত্ত সত্য দ্বীনের অনুসন্ধান করবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কুরআনে তার আরও একটি বিশেষ নিয়ম বলে দিয়েছেন। আর তা হলো যতক্ষণ পর্যন্ত রাসুলের মাধ্যমে সত্যকে চূড়ান্তরূপে প্রমাণিত করে দেখিয়ে দেয়া না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ কাউকে আজাবে নিক্ষেপ করবেন না।(৭) তাই হুজ্জাত (সত্যের চূড়ান্ত প্রমাণ) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
হুজ্জাতের এ বিষয়েটি পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। হুজ্জাতের সিলসিলা এজন্য জারি করা হয়েছিল যে কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট কেউ যেন ওজর পেশ করতে না পারে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ আমাদের বলেছেন যে দুনিয়াতে পাঠানোর পূর্বেই আমরা সকলে তার সম্মুখে ওয়াদা করে এসেছিলাম যে তিনিই আমাদের রব।(৮)
সুতরাং অজুহাত পেশ করার রাস্তা বন্ধ করা জরুরি। যখন অজুহাত পেশ করার সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে তখন কিয়ামতের দিন আল্লাহ আমাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন ইসলাম আমাদের নিকট পূর্ণাঙ্গভাবে পৌঁছানোর পর আমরা তা কবুল করেছি কিনা।
তবে কুরআন থেকে আমরা এটাও জানতে পারি যে যাদের নিকট দাওয়াত পৌঁছায়নি অথবা যারা সত্য পথে চলার চেষ্টা করেছে কিন্তু সত্যকে সঠিকভাবে খুঁজে পায়নি, তাদের এ সকল অজুহাত যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে আল্লাহ তাদের অবস্থান বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তাদের সাথে কোনো প্রকার জুলুম করা হবে না।(৯)
তথ্যসূত্র:
১-বাকারাহ: ৩৯
২-নামল: ১৪
৩-সূরা কাফিরুন: ১
৪-সূরা বাকারা: ৬
৫-আলে ইমরান: ১৯
৬-আন‘আম: ১৬৫
৭-বনী ইসরায়েল: ১৫
৮-সূরা আরাফ: ১৭২
৯- নাহল: ১১১
উস্তাদ জাভেদ আহমদ গামিদি সাহেরে লেকচারের বাংলা অনুবাদ
আনুবাদ: ইবনে আনিস ইবনে ইসমাইল
সম্পাদনা: উস্তাদ মনজুর এলাহী ও শাইখ উমর ফারুক